জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২০ এ সেরা নারী কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে কনা ও কোনাল। ‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ গানের জন্য কোনালের হাতে উঠেছে জাতীয় পুরস্কার।
তবে কোনালের গাওয়া ‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ গানটি নিয়ে উঠেছে বিতর্ক। বীর সিনেমায় ব্যবহার করা গানটিতে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া অবুঝ হৃদয় সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় ‘তুমি আমার জীবন’ গানের প্রথম দুটি লাইন ও সুর ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো গানটির সুর করেছেন কলকাতার আকাশ সেন।
কথা ও সুরের মিল থাকায় ‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ গানটি নকলের অভিযোগ এসেছে খোদ বীর সিনেমার প্রযোজক মো. ইকবালের কাছ থেকে। গানটি নকল দাবি করে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নকল গান গাওয়ার জন্য কীভাবে কণ্ঠশিল্পী কোনাল পুরস্কার পান!’
তবে সুর অনুকরণে সমস্যা দেখছেন না অবুঝ হৃদয় সিনেমার প্রযোজক মোহাম্মদ হোসেন। তিনি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন, ‘তুমি আমার জীবন’ গানের প্রথম দুই লাইন ‘তুমি আমার জীবন/আমি তোমার জীবন’ নতুন গানে ব্যবহারের আগেবীর সিনেমার সংশ্লিষ্টরা মৌখিক অনুমতি নিয়েছেন। এ দুটি লাইন ব্যবহার করায় তার কোনো অভিযোগও নেই।
‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ গানের গীতিকার কবির বকুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুমতি নেয়া আছে শুনেই গানটি লিখেছে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিভাগটি যেহেতু শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী, তাই এখানে কণ্ঠটাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এখানে কিন্তু গানের কথা মুখ্য না।’
মোহাম্মদ হোসেনের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার বিষয়ে প্রযোজক মো. ইকবালও নিশ্চিত। তার আপত্তি, নকল গানে কোনালের পুরস্কার পাওয়া নিয়ে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গানের ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। আমার কথা হলো গানটি নকল। তাই এ গানটি গাওয়ার জন্য কেন কণ্ঠশিল্পীকে জাতীয় পুরস্কার দেয়া হবে।’
এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে নতুন গানে পুরনো কোনো গানের লাইন, শব্দ বা সুরের কিছু অংশ থাকলে সেটি কি মৌলিকত্ব হারাবে?
বিষয়টি জানতে নিউজবাংলা যোগাযোগ করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুরনো গানের কিছু লাইন ও সুর নতুন গানে ব্যবহার করায় সেটির স্বীকৃতি পেতে বা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়ায় কোনো অসুবিধা নাই। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আগে থেকেই মানতে হবে।’
সেগুলো মানা হয়েছে কি না- খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন জাফর রাজা চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘যে কোনো গানের ক্ষেত্রে কপিরাইটে দুটি স্বত্ব থাকে। একটা হলো মোরাল রাইট, আরেকটি হলো কমার্শিয়াল রাইট।
‘গানের ক্ষেত্রে নৈতিক রাইটটা থাকে গীতিকার বা সুরকারের কাছে। সিনেমার গানের ক্ষেত্রে প্রযোজক অর্থের বিনিময়ে গান সৃষ্টির কাজ করান, তাই কমার্শিয়াল রাইটটা প্রযোজকের কাছে থাকে। পরবর্তীতে গানটি অন্য কোথাও ব্যবহার বা রি-রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজক অনুমতি দিতে পারেন।
‘কিন্তু গানটির কিছু লাইন বা সুর যদি অন্য কেউ অন্য কোথাও ব্যবহার করতে চান বা নতুন কিছু কথার সঙ্গে পুরনো গানের কথা মিশ্রণ করতে চান তাহলে মূল গানটির যিনি গীতিকার বা সুরকার, তাকে জানাতে হবে এবং অনুমতিও নিতে হবে।’
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করতে জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘পুরনো গান হুবহু নতুন কোনো সিনেমা-নাটকে ব্যবহার করতে চাইলে প্রযোজকের অনুমতি লাগবে।
‘কিন্তু যদি পুরনো গানটার অংশবিশেষ বা পুরনো গানটাকে ভিত্তি করে অন্য কিছু করতে চায় কেউ, তাহলে অবশ্যই গীতিকার বা সুরকারের অনুমতির প্রয়োজন আছে। এটাকে বলে মোরাল রাইট।’
‘তুমি আমার জীবন/আমি তোমার জীবন’ গানের গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রয়াত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাকে বিষয়টি জানানো বা তার কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়।
জাফর রাজা চৌধুরীর ভাষ্যে, ‘নতুন গানটিকে কোনো ধরনের প্রশ্ন থেকে দূরে রাখতে চাইলে অবশ্যই আগের গানের গীতিকার ও সুরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং তার/তাদের নাম উল্লেখ করতে হবে। যেহেতু আহমেদ ইমতিয়াজ প্রয়াত, তাই এ ক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকারের কাছ থেকে নিতে হবে মোরাল রাইট। তা না হলে প্রশ্ন এড়ানো যাবে না।’
এ ক্ষেত্রে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের পরিবারের সঙ্গে বীর সিনেমার সংশ্লিষ্টদের কারও কথা হয়নি বলে নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন বীর সিনেমার প্রযোজক মো. ইকবাল ও গীতিকার কবির বকুল।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দিতে যে জুরি বোর্ড গঠন করা হয়, তারা একটি নীতিমালা অনুসরণ করেন। কোনো গানকে পুরস্কৃত করতে হলে অবশ্যই সেই গানটিকে পুরোপুরি মৌলিক হতে হবে- এমন কোনো শর্ত নীতিমালায় নেই।
জুরি বোর্ডের সদস্য রিয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন কোনো নিয়ম নেই। তবে আমরা সবসময় মৌলিকত্বকে প্রাধান্য নেই। যে গানটির বিষয়ে আপনি জানতে চাচ্ছেন, সেটি আমাদের সবার কাছে নতুন একটি বিষয়। যদি কপিরাইটের কোনো ঝামেলা না থাকে তাহলে এমন গান পুরস্কৃত হলে হয়তো সমস্যা নাও হতে পারে। আগামীতে এমন বিষয় নীতিমালায় উল্লেখ থাকতে পারে। আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।’
অবুঝ হৃদয় সিনেমার ‘তুমি আমার জীবন’ গানটি রয়েছে অনুপম মুভি সং নামের ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মহসীন মেহেদী নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, তাদের কাছে আছে গানটির ডিজিটাল স্বত্ব। আর কমার্শিয়াল রাইট এখনও প্রযোজকের কাছে।