৪ মার্চ থেকে ৪ জানুয়ারি- এই সময়টা গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছিলেন অভিনেতা অনিক রহমান অভি।
অভিনেতার দাবি, তিনি কখনই মাদকাসক্ত ছিলেন না, তাকে জোর করেই সেখানে রাখা হয়েছিল।
৪ জানুয়ারি গাজীপুরে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে র্যাব-১-এর অভিযানে উদ্ধার হন অভি এবং সেখানকার কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে অভিকে মাদকাসক্ত নন বলেই ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।
অভিযানের পর সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, মাদক নিরাময় অধিদপ্তরের দেয়া নিয়ম এখানে মানা হচ্ছিল না। অভিযানের সময় সেখান থেকে ৪২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, ‘যারা এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হয়রানি, ঝুলিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং তার প্রমাণ মিলেছে।’
অভিনেতা অভির দাবি, নেশায় আসক্ত হবেন দূরের কথা, তিনি চা পান করেন না, ধূমপানও করেন না।
তাহলে তিনি কেন মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে? কী হয়েছে তার সঙ্গে? এসব বিষয় নিয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন অভি।
অভি বলেন, ‘করোনার সময় আমি খুব হতাশ হয়ে যাই। আমার তিনটি রেস্টুরেন্ট ছিল, সবগুলোতেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই আমি। তখন থেকে ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করি। অনেক করে খেতাম তা না, দু-তিনটা করে খেতাম এবং তা স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে।’
সম্যাটা শুরু তখন থেকেই। কারণ ব্যবসায় লস এবং ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্য অভির কিছু সমস্যা সবার চোখে পড়ে।
অভির বাসা রাজধানী লাগোয়া জনপদ টঙ্গী, যেটি প্রশাসনিক সীমানা অনুযায়ী গাজীপুর জেলায়। সেখানে তার মা, স্ত্রী, তিন বছরের মেয়ে এবং ছোট ভাই থাকেন। বাবা পুলিশ বাহিনীতে ছিলেন, এখন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।
অভিনেত্রী পপির সঙ্গে অভি। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যরা নোটিশ করেন যে, অভির আচরণ খিটখিটে হয়ে গেছে, ওজন কমে যাচ্ছে। এসব দেখে তাদের নানা কিছুই মনে হতো, কিন্তু কিছু বলতেন না।
অভি বলেন, ‘আমার একটি সিনেমার প্রযোজক ছিলেন গাজীপুরের। তার মাধ্যমে শিপন নামে একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। শিপন হলেন সেই মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রধান ফিরোজা নাজনীন বাঁধনের তথাকথিত স্বামী।
‘শিপনের আমাদের বাসায় যাতায়াত ছিল। সেই প্রথমে আমার মাকে বলে যে, আমাকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছে। আমার কিছু টেস্ট করা প্রয়োজন।
‘সরাসরি আমাকে বললে হয়তো আমি অন্যভাবে নিতে পারি, তাই আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমাকে নিয়ে যায় গাজীপুরে।’
সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা, যা কখনই অভি কল্পনা করতে পারেনি।
অভির পরীক্ষা করা হয় এবং তাকে মাদকাসক্ত প্রমাণ করে তার বাড়িতে ৩ লাখ টাকা চাওয়া হয়। অভির পরিবার সেটা দেয়। অভিকে চিকিৎসা করে ভালো করা হবে, ভালো করে রাখা হবে- এমন কথা বলে প্রতি মাসে আরও ৪০ হাজার টাকা করে নেয়া হতো।
প্রথম দিকে পরিবারকে বলা হয়, তিন মাসের জন্য অভিকে থাকতে হবে সেখানে।
মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিকে বলা হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ঘুমের ওষুধের ব্যবহার পাওয়া গেছে। এটা ঠিক করতে তিন মাস লাগবে। এরপর অভিকে এক কথা আর তার পরিবারকে বলা হতো আরেক কথা।
অভি বলেন, ‘আমাকে বলা হতো আমার বাবা-মা নাকি আমাকে দেখতে চায় না, এ কথা বলা হতো আমাকে। আর আমার বাসায় বলা হতো, আমার অবস্থা খুব খারাপ, আমি বাসায় গেলে আর আসতে চাইব না। তাই তাদের আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হতো না।’
অভির ভাষ্যে, তিনি মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে ভয় পেয়ে যান। একটা কক্ষে ২৫ থেকে ৩০ জন রাখা হতো সেখানে, খাট নয়, মেঝেতে। কনডেন্স মিল্কের কৌটায় যতটুকু চাল ধরে, ততটুকু চাল ব্যবহার করা হতো তিনজন মানুষের জন্য।
তিন বেলা খাবার দেয়া হতো সেখানে। কিন্তু যা দিত, তা দিয়ে পুষ্টি পূরণ হয় না।
সকাল ৭টায় দিত চাল, হুলুদ রং এবং লবণ দিয়ে তৈরি খাবার, যাকে নাম দেয়া হয় খিচুড়ি। বেলা দেড়টার দিকে দেয়া হতো আলু আর ডিমের একটা খাবার। রাত সাড়ে ৮টায় দিত ডাল, আলু ভর্তা।
প্রথম কয়েক দিন ভালোই খাবার দিচ্ছিল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এরপর আরেকটি পরীক্ষা করা হয় অভির। আর সেই টেস্টের পর অভিকে বলা হয় তার মানসিক সমস্যা। এটা তিনি নিজে বুঝতে পারছেন না।
এ কথা শুনে অভি তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও ভুল তথ্য দিয়ে অভি এবং তার পরিবারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করা হতো।
এভাবে আড়াই মাস কাটে অভির। এর মধ্যে তিনি জেনে যান যে সেখানে মাদকের ব্যবসা হয় এবং কেন্দ্রের মালিক এর সঙ্গে জড়িত।
অভি বলেন, ‘ওখানে পুরোনো তাদের অনেকে কাছে জানতে পারি, কেন্দ্রের যে নারী মালিক রয়েছেন তিনি নাকি ছেলেদের অ্যাবিউজ করেন। যারা একটু সুস্থ, তাদের সঙ্গে এ কাজটি করা হতো।
অভিনেত্রী শাবনূরের সঙ্গে অভি। ছবি: সংগৃহীত
‘আড়াই মাস পর আমার সঙ্গেও এমন একটা ঘটনা ঘটে। সেই নারী আমাকে তার বাসার নিচতলায় যেখানে তিনি থাকেন সেখানে নিয়ে যান।
‘আমি তখন ভয় পাচ্ছি, কারণ সেখানে আমি অনেককে উল্টো করে ঝুলিয়ে মারতে দেখেছি। সেখানে মারা হতো গামছা ভিজিয়ে। একটি মুখে গুঁজে দেয়া হতো, আরেকটি দিয়ে মারা হতো। এতে করে শরীর কাটত না কিন্তু ব্যথাটা রয়ে যেত। আমাকে উল্টো করে মারেনি কিন্তু তিনি আমাকে অ্যাবিউজ করা হয় সে সময়। এ ঘটনা আমার সঙ্গে একবারই হয়েছে।’
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই ধরনের আচরণ করা হয়েছে, তার সাক্ষী তিনি নিজে।
আড়াই থেকে-তিন মাস পূর্ণ হওয়ার মধ্যে অভিকে নিয়ে যাওয়া হয় খিলক্ষেতে। সেখানে জাকারিয়া নামে এক চিকিৎসককে দেখান হয় তাকে। সেই চিকিৎসক তাকে ছেড়ে দিতে বলেন এবং কিছু ওষুধ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন।
তিন মাস পর যখন নিরাময় কেন্দ্র থেকে বাসায় ফেরার কথা, সে সময় অভির পরিবারকে বলা হয়, অভি প্রচণ্ড রেগে আছেন এবং তার মানসিক অবস্থাও ভালো না। তিনি যেকোনো সময় খুন করে ফেলতে পারেন এবং মানসিক চিকিৎসক বলেছেন আরও তিন মাস সেখানে থাকতে হবে।
অভি বলেন, ‘এসব কথা শুনে মা তো কান্নাকাটি। সে আমার জন্য অনেক কিছু পাঠাত, কিন্তু আমি কিছুই পেতাম না। শুক্রবার আমাদের ৫০ গ্রাম করে মুরগির মাংস খাওয়ানো হতো। ওই দিন ফ্যামিলির মানুষরা দেখা করতে পারেন। এ জন্য কেন্দ্রে সেটা ঈদের দিন। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা তো ভালো হচ্ছে না, আমি ওদের অনেক বিরক্ত করা শুরু করি। আর সে জন্য তারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আমাকে ইনজেকশন দেবে।’
ইনজেকশনটা দিলে রোগীর সেন্স কাজ করত না। মুখ থেকে লালা পড়ছে, হাত-পা কাঁপছে, কতটুকু খাচ্ছে-কতটুকু ফেলে দিচ্ছে তার কিছুই বুঝতেন না রোগী। চোখ খুলে তাকাতেও পারতেন না।
এমন তিনটি ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল অভিকে। আর ইনজেকশন দিয়ে পরিবারকে দেখা করতে বলা হতো অভির সঙ্গে। তারাও দেখে মনে করত আসলেই অভির অবস্থা খুব খারাপ। এমন সমস্যার কারণে আমেরিকা থেকে অভির বাবাও দেশে চলে আসেন ছেলেকে দেখতে। কিন্তু তিনিও বুঝতে না পেরে ছেলেকে রেখে যান সেখানে।
চতুর্থ ইনজেকশনটা আর নিতে পারব না বলেই অনেক চেষ্টা করে বের হওয়ার উপায় খুঁজে বের করেন অভি।
অভি বলেন, ‘রোগীদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না, তাদের কেন্দ্র ছেড়ে দেয়। কারণ তাদের রেখে লাভ নাই। তো যারা ছাড়া পায় তারা আবার মাঝে মাঝে কেন্দ্রে ঘুরতে আসে। তেমন একজনকে আমি খুব অনুরোধ করলাম তার মোবাইল দেয়ার জন্য এবং সে মোবাইলটা দেয়।
‘প্রথম আমি বিডি ফিল্ম বাজ নামের ফেসবুক পেজে গিয়ে সেলিম সাকিবের নম্বরে ফোন করি এবং অভিনেতা জয় চৌধুরীর নাম্বার চাই। কারণ জয়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। জয়ের সঙ্গে কথা বলে আমি জায়েদ খানকে ফোন করি।
অভিনেত্রী মৌসুমীর সঙ্গে অভি। ছবি: সংগৃহীত
“জায়েদ ভাই সব শুনে বললেন, ‘তুই টেনশন করিস না আমি আছি।’ তখন মনে হলো, আমি আলো দেখতে পারব। অনেক কষ্ট করে বাথরুমে, কিচেনে গিয়ে কথা বলতাম। কারণ ফোন ধরার কোনো সুযোগ ছিল না। সিসি ক্যামেরা ছিল।”
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে র্যাবের একটি টিম কেন্দ্রে আসে। সবাই ছিল নিচে। অভিকে ডেকে আনা হয় দোতলা থেকে।
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে অভি বলেন, ‘আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওদের ধরে আমি কিছুক্ষণ কাঁদলাম। মনে হচ্ছিল আমার নতুন জন্ম হচ্ছে। একে একে তারা সব কাগজ চেক করল। তারপর সেখান থেকে আমাকে নেয়া হলো র্যাব হেডকোয়ার্টারে। সেখানে রাতে ছিলাম।’
কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন অভি। আপাতত টঙ্গী থাকছেন না তিনি। নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন র্যাব ও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতি। নতুন জীবনে আর হতাশা নয়, নতুন করে সাজাতে চান আগামী।