‘গাড়ি চলে না’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’র মতো লোকগানগুলোকে নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছেন তিনি। নব্বইয়ের দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে টগবগে এ যুবক গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে রাজপথে গানে গানে বলে গেছেন গণমানুষের কথা।
আবার তিনিই হৃদয়ের দাবি নিয়ে গানে গানে বলে গেছেন, ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি দুহাতে আগুন তারও/ কার মালা হতে খসে পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়/যার হাতখানি পুড়ে গেলো বধূ আঁচলে তাহারে ঢাকো/ আজও ডানা ভাঙা একটি শালিক হৃদয়ের দাবি রাখো।’
তার গানে গানে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে প্রেম, বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের কথা। তিনি সঞ্জীব চৌধুরী।
একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও সংগঠক সেই মানুষটির জন্মদিন আজ।
তার জন্মদিন স্মরণে হতে যাচ্ছে ‘দশম সঞ্জীব উৎসব ২০২১’। শনিবার এ উৎসব হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সঞ্জীব চত্বরে।
২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সঞ্জীব উৎসব উদ্যাপন পর্ষদ’ আয়োজন করে আসছে এ উৎসবের।
দশমবারের মতো আয়োজিত এ উৎসবে গান করবে ব্যান্ড দল শুভযাত্রা, সাবকনশাস, বে অফ বেঙ্গল, দুর্গ, ইন্ট্রোয়েট ও ব্যান্ড বিস্কুট। এ ছাড়াও গাইবেন জয় শাহরিয়ার, সাহস মোস্তাফিজ, লালন মাহমুদ ও সুহৃদ স্বাগত।
এবারের উৎসবে প্রকাশ হতে যাচ্ছে সঞ্জীব চৌধুরীর গান কবিতা সমগ্র ‘তোমাকেই বলে দেবো’। জয় শাহরিয়ারের সংকলন ও সম্পাদনায় বইটিতে সঞ্জীব চৌধুরীর প্রকাশিত সব লিরিক পাওয়া যাবে এক মলাটে। বইটি প্রকাশ করছে আজব প্রকাশ।
১৯৯০ সালে প্রকাশিত সঞ্জীব চৌধুরীর প্রতিস্পর্ধী গদ্য ‘রাশপ্রিন্ট’। বলা উত্ত্যুক্তি হবে না যে, বইটি সে সময়ের নথিকৃত দৃশ্যগাঁথা।
আশির দশকের স্বৈরাচারী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আমাদের সমাজ আর মগজে যে দখলদারত্ব কায়েম করেছিল, ‘রাশপ্রিন্ট’ তারই গদ্যকল্প।
১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারসহ কয়েকজনকে নিয়ে সঞ্জীব তৈরি করেন গানের দল ‘দলছুট’, যা তাকে এনে দেয় খ্যাতি।
মিছিলে মিছিলে মুক্তির গান গাওয়া সঞ্জীব প্রায় অজানা এক মানুষ, কিন্তু তার ‘রাশপ্রিন্ট’-এ খুঁজে পাওয়া যায় সেই মানুষটাকে।
তিনি সাধারণের হয়ে উঠেছিলেন গানের মাধ্যমে। ৪৩ বছর বেঁচেছেন তিনি। কাজের হিসেবে এই সময়েই তার অর্জন বিশাল।
যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই কাজ করেছেন ক্ষণজন্মা এ শিল্পী। সংগীতে নানাভাবে পাওয়া গেছে তাকে।
‘আমি ঘুরিয়া ফিরিয়া সন্ধান করিয়া, স্বপ্নের অই পাখি ধরতে চাই’ গানটিতে পাওয়া যায় স্বপ্নবাজ এক সঞ্জীবকে।
আবার ভালোবাসার মধুর স্মৃতি মনে করে তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ।’
একজন প্রেমিক সঞ্জীবের দেখা বেশ ভালোভাবেই পাওয়া গেছে তার সৃষ্টিকর্মে। ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’, ‘হাতের উপর হাতের পরশ’, ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন’, ‘তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও’, ‘হৃদয়ের দাবি’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’সহ আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে তার।
এসব গানের মাধ্যমেই সঞ্জীবের স্বপ্ন ও কথা বয়ে বেড়ায় এ প্রজন্মের তরুণেরা। তাই তো এখনও কোনো তরুণ প্রাণের আড্ডায় বা মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় কেউ গেয়ে ওঠে ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো/কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে/ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া।’
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্ম এ শিল্পীর। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর বাই লেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার।