হঠাৎ করেই দেশে নির্মিত সিনেমাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। মর্যাদাপূর্ণ উৎসবগুলোয় সেগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে, প্রতিযোগিতা পর্যায়ে সেগুলো বিশ্বের অন্যান্য চলচ্চিত্রের সঙ্গে লড়াই করছে। নির্মাতারা সিনেমা বানানোয় ব্যস্ত হয়ে উঠছেন, কিছুদিন আগেও যারা হাত গুটিয়ে অলস বসে ছিলেন।
গত জানুয়ারিতে নবীন পরিচালক রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের নোনা জলের কাব্য সিনেমাটি অংশ নেয় কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে হয় দুটি প্রদর্শনী। এটি দেশের জেলে সম্প্রদায়ের গল্প, যারা নিরন্তর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে।
এটির পরিচালকের মতে সবচেয়ে বড় অর্জনটি ছিল জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ সিনেমাটির প্রদর্শনী। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে ২৯ অক্টোবর ও ৮ নভেম্বর দেখানো হয় সিনেমাটি।
দেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় খবরটি আসে জুন মাসে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসর কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল সিলেকশনে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশের সিনেমা।
৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে অফিশিয়াল সিলেকশনের আঁ সঁতে রিগা বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনিত হয় নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের সিনেমা রেহানা মরিয়ম নূর। দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা ঘটে।
এপর সিনেমাটি ঘুরেছে আরও ১৪টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।
সম্প্রতি সিনেমাটি হংকং এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভালে পেয়েছে নিউ ট্যালেন্ট অ্যাওয়ার্ড। এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে আজমেরী হক বাঁধন এবং সিনেমাটি পায় জুরি পুরস্কার (যৌথভাবে)।
দক্ষিণ এশিয়ার সম্মানজনক বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দুটি ভিন্ন বিভাগে প্রতিযোগিতা করে দেশের তিন সিনেমা। এর মধ্যে কিম জিসেওক অ্যাওয়ার্ডে মনোনীত হয় খ্যাতিমান নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত সিনেমা নো ল্যান্ডস ম্যান।
এখানে ‘আ উইনডো অব এশিয়ান সিনেমা’ বিভাগে স্থান করে নেয় মোহাম্মদ রাব্বী মৃধা পরিচালিত নো গ্রাউন্ড বিনেথ দ্য ফিট (পায়ের তলায় মাটি নাই) এবং রেহানা মরিয়ম নূর।
৬ অক্টোবর শুরু হয় বুসানের ২৬তম আসর, চলে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
আয়নাবাজি খ্যাত পরিচালক অমিতাভ রেজা পরিচালিত মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমা রিকশা গার্ল সিনেমাটি আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান ইন্টারন্যাশনাল চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়।
দ্বিতীয় সফর হিসেবে অক্টোবরে উত্তর আমেরিকা যায় সিনেমাটি। অংশ নেয় মিল ভ্যালি চলচ্চিত্র উৎসবে।
পুরস্কারও এসেছে রিকশা গার্ল সিনেমার ঘরে। অক্টোবরে আমেরিকার প্রেসকট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে জুরি অ্যাওয়ার্ড বিভাগে বেস্ট ন্যারেটিভ ফিচার ফিল্মের পুরস্কার জেতে সিনেমাটি।
অক্টোবরে আরও একটি পুরস্কার জেতে রিকশা গার্ল। জার্মানির ২৬তম শ্লিঙ্গেল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসএলএম টপ অ্যাওয়ার্ড জেতে রিকশা গার্ল।
নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আমস্টারডামের (ইডফা) মূল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয় নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের নতুন সিনেমা অন্যদিন…। ২০ নভেম্বর প্রাইম টাইম স্ক্রিনিংয়ে রাত ৯টায় বিশ্ব অভিষেক হবে সিনেমাটির।
নভেম্বরে আরও একটি ফেস্টিভ্যালে প্রতিযোগিতার জন্য গিয়েছে ফারুকীর নো ল্যান্ডস ম্যান। এস্তোনিয়ার তালিন চলচ্চিত্র উৎসবের কারেন্ট ওয়েব সেকশন বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়েছে সিনেমাটি। উৎসবে জমা দেয়া সিনেমার মধ্যে যারা প্রথমবার সিনেমা পরিচালনা করেছেন, তাদের সিনেমা বিচারের দায়িত্বে আছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
২০ নভেম্বর থেকে ভারতের গোয়ায় বসছে উপমহাদেশের অন্যতম চলচ্চিত্র উৎসব ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল অব ইন্ডিয়া (আইএফএফআই)। উৎসবের এবারের আসরে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন পিকক’ এর জন্য লড়বে দেশের সিনেমা পায়ের তলায় মাটি নাই।
উৎসব ছাড়াও কান চলচ্চিত্র উৎসবের বেশ কিছু টুকরো আয়োজনে চলতি বছর পুরস্কৃত হয়েছে এবং অংশ নিয়েছে দেশের সিনেমা।
দেশের গুপী বাঘা প্রোডাকশন প্রযোজিত নুহাশ হুমায়ূনের প্রথম সিনেমা মুভিং বাংলাদেশ অংশ নেয় কান চলচ্চিত্র উৎসবের মার্শে দ্যু ফিল্মে। মার্শে দ্যু ফিল্মের (বাণিজ্যিক শাখা) অন্যতম একটি প্রোগ্রাম ‘কান ডকস’।
‘ডকস-ইন-প্রোগ্রেস’ বিভাগের থিঙ্ক-ফিল্ম ইম্প্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় তথ্যচিত্র আমাদের কন্যারা। ১৩ জুলাই এ ঘোষণা আসে। আমাদের কন্যারা নির্মাণ করছেন তাহরিমা খান ও প্রযোজনা করছেন জালালের গল্প খ্যাত পরিচালক আবু শাহেদ ইমন।
সেপ্টেম্বরে টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বাজার সম্প্রসারণ উদ্যোগ টোকিও গ্যাপ ফাইন্যান্সিং মার্কেট (টিজিএফ) এ জায়গা করে নেয় বাংলাদেশের একমাত্র সিনেমা মুভিং বাংলাদেশ। সেখান থেকে গ্র্যান্টও পায় সিনেমাটি। সিনেমাটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গুপী বাঘা প্রোডাকশনস।
বিশ্ব চলচ্চিত্র আসরে দেশের সিনেমা অংশগ্রহণ নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন খবর নিয়মিত। তবে এ বছর এরকম খবর ঘনঘনই আসছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিচালক-প্রযোজক আবু শাহেদ ইমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর অনেক সিনেমা বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং প্রতিযোগিতা করেছে। সংখ্যার দিক দিয়েও এটা ভালো। তবে আমার আনন্দটা অন্য জায়গায়। অনেক বছর ধরে উৎসবে সিনেমা পাঠানোর পাশাপাশি ইন্টারেস্টিং ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা নির্মাণও জরুরি।’
ইমন মনে করেন ইন্টারেস্টিং ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা নির্মাণের ধারাবাহিকতা আছে দেশে।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় একটা ফ্লো তৈরি হয়েছে। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা, নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন অনেক বেশি সক্রিয়। দর্শকরাও নতুন ধরনের কাজ দেখতে চায়।’
দর্শক বিন্যাস নিয়ে ইমন বলেন, ‘সিনেমা হল কমে যাওয়ার কারণে প্রান্তিকের দর্শক সিনেমা দেখতে পাচ্ছেন না। ইউটিউব, ফেসবুক তাদের বিনোদনের জায়গা হয়ে গেছে। আমরা যারা মহানগরে সিনেমা হলে যেতে পারছি তারা ইন্টানেস্টিং গল্প প্লট এবং নির্মাণ খুঁজছি। এমন ব্যাবস্থাপনায় ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা আরও নির্মিত হবে বলে আমার মনে হয়।’
ইমন আরও মনে করেন, সরকার চলচ্চিত্রে গত দু্ই বছরে ৩৬টি সিনেমা অনুদান দিয়েছেন এবং সিনেমাগুলোর অধিকাংশই তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার বয়ান কৌশলের চেয়ে স্বাধীন নির্মাতাদের নির্মাণ ঢংয়ে নির্মিত হবে।
সম্প্রতি শেষ হয়েছে কাগজ নামের একটি সিনেমা। এর পরিচালক জুলফিকার জাহেদি আগেই জানিয়েছেন, তার সিনেমাটি আগে উৎসবগুলোতে পাঠানোর ইচ্ছা তার।