ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গানের দল মেঘদলের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীর করা মামলায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংগীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
তারা বলছেন, এ ধরনের মামলা সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিনের পুরোনো একটি গান সামনে এনে বিশেষ উদ্দেশ্যে পূরণ করতে চাইছে একটি গোষ্ঠী।
এবার মামলা করা আইনজীবী ইমরুল হাসান এর আগেও একই ধরনের দুটি মামলা করেছেন। ইমরুলকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংগীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ও দলছুট ব্যান্ডের কর্ণধার বাপ্পা মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুধু মেঘদল নয়, আমি মনে করি এটা আমাদের সবার জন্যই অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং দুঃখজনক একটি ব্যাপার। শিল্পীর বিরুদ্ধে এভাবে মামলা করার যৌক্তিকতা কী- সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। যে ঘটনাটি ঘটেছে আমি তার নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ জানাই।’
সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য মামলা হতে পারে এমন আইনই বাতিল করা উচিত। শুধু মেঘদলের শিল্পীরা নয়, শরীয়ত বাউল, রিতা দেওয়ানসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনাও আছে। এসব আইন ও মামলা দিয়ে দিন দিন আমাদেরকে কূপমণ্ডকতার দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চলছে।’
লীলা ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সংগীত শিল্পী, লেখক ও গবেষক অরূপ রাহী বলেন, ‘মেঘদলের গানের প্রতি কোনো রকম মুগ্ধতা আমার নেই, ভালোও লাগে না। সেটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত এস্থেটিক পজিশন ও চর্চার ব্যাপার। যে গান নিয়া ইস্যু, সে গানের ব্যাপারেও আমার কোনো অনুরাগ নাই, বরং তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণী সংবেদনের কাঠামোর ব্যাপারে তীব্র পার্থক্য এবং বিরোধিতা বা সমালোচনা আছে।’
তিনি বলেন, ‘শরীয়ত বাউল, রিতা দেওয়ান বা পালাগান-বয়াতী গানের তাত্ত্বিক কাঠামো এবং তথ্য/পদ্ধতি একটা বিশেষ ঐতিহাসিক-সামাজিক-জ্ঞানগত বিশেষত্ব ও সীমাবদ্ধতা নিয়েই চলমান- সেটা খেয়ালে রেখেও এর ফর্ম এবং ইতিহাসের প্রতি, এই চর্চার কমিউনিটির প্রতি আমার সাধারণ শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ আছে।
‘কিন্তু এসব রাগ-অনুরাগের বাইরে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে এসব গানের শিল্পীদের নামে মামলা দেয়ার এবং নেয়ার, হয়রানি এবং জুলুমের নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। কারণ, এগুলো অন্যায়, অবিচার, জুলুম। এগুলো করে ব্যক্তি, সমাজ এবং দেশের ক্ষতি করা হয়, এগুলো বন্ধ করা দরকার।’
ব্যান্ড দল সমগীতের প্রতিষ্ঠাতা অমল আকাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন করে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসিলায় বাংলাদেশকে একটা অস্থিরতার মধ্যে ফেলে অসাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সাম্প্রদায়িকের টুর্নামেন্টের আয়োজনের জোর চেষ্টা চলছে। আমি সন্দেহ করি, এর সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো না কোনো ফর্মে ইন্ধন আছে। মেঘদলের এই গান অনেক আগের। এতদিন পরে এই গান নিয়ে অনুভূতিতে আঘাত লাগার মামলা করায় বোঝাই যায় এটি চক্রান্তের অংশ। সাম্প্রদায়িক ইস্যুটিকে বড় করার জন্যই এই মামলা। এসবের প্রতিবাদ ও সেই সঙ্গে আমাদের লড়ে যেতে হবে।’
প্রকাশক, অ্যাক্টিভিস্ট ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের অন্যতম সমন্বয়কারী রবিন আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এতদিন আগের একটি গান, অথচ এই সময় এসে সেই গান নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করা হলো। এসব মামলার মধ্যে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এর প্রতিবাদ তো অবশ্যই জানাই, সেই সঙ্গে প্রয়োজনে আমরা রাস্তায় নামব।’
মামলাকারী আইনজীবীর সনদ বাতিলের দাবি জানান রবিন আহসান।
মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেঘদল চাইলে আমি তাদের আইনগত সহায়তা দেব।
‘মেঘদলের এই গান যদি ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হয়, তাহলে কাওয়ালী, বাউলগান, মিলাদ এগুলোও ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত। এগুলোও তো বন্ধ করে দেয়া উচিত। এই গানে যদি ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত পড়ে তাহলে সব গানই বন্ধ হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে করা কোনো মামলা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। এমন কোনো মামলা শেষ হয়েছে বলেও আমি পাইনি।’
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি আদালতে প্রমাণের পদ্ধতি কী হতে পারে, জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, ‘এটা তো আমারও প্রশ্ন। আদালত যে কগনিজেন্স (অভিযোগ) নিল, কী শুনে নিল? এখন কেউ বললো আমি আঘাত পেয়েছি, কীভাবে পেল, কেমনে পেল- সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। আসলে এটা হলো কিছু লোককে হয়রানি করার উদ্দেশ্য, আর কিছু না।’
দুর্গা পূজার সমূয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে গত ২২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে 'সহিংসতার বিরুদ্ধে কনসার্ট' করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত কনসার্টে বেশ কয়েকটি ব্যান্ড ও একক শিল্পীসহ মেঘদলও সঙ্গীত পরিবেশনা করে। পরে মেঘদলের পরিবেশিত 'ওম' গানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মামলা করেন আইনজীবী ইমরুল হাসান।
‘ওম’ গানটি ২০০৪ সালে মেঘদলের ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’ শিরোনামের অ্যালবামে প্রথম প্রকাশিত হয়।
মামলার অভিযোগে ইমরুল হাসান বলেছেন, ২৬ অক্টোবর তিনি বাসায় অবস্থানের সময় সকাল ৭টার দিকে ইউটিউবে ঢোকেন। বিভিন্ন ভিডিও দেখার সময় দেখতে পান মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একটি দোয়া বা ইসলামি প্রার্থনা নিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্যবাজনা তথা আধুনিক মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে বিকৃত সুরে গান আকারে গাওয়া হচ্ছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গানের অনুষ্ঠানটি টিএসসিতে ভাস্কর্যের সামনে করা এবং পেছনে সাইনবোর্ড আকারে লেখা ছিল ‘সহিংসতা’। পবিত্র কালিমার অংশও গানের তালে পাঠ করা হয়েছে। ফলে এ গান তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত হেনেছে।