সেন্সর আইন সংশোধনের উদ্যোগ দুই বছর ধরে খসড়া হয়েই পড়ে আছে। সংসদে বিল আকারে উত্থাপনের পর্যায়ে এটি যেতে পারেনি। ফলে বয়স অনুযায়ী সিনেমার রেটিং করার উদ্যোগ এখনও পরিকল্পনা পর্যায়েই থেকে গেছে।
‘দ্য সেন্সরশিপ ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ (সংশোধিত ২০০৬)’ আইনের আওতায় এখনও পরিচালিত হচ্ছে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। এটি পরিবর্তন করতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ করা হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’- এর খসড়া।
একই বছরের মার্চ মাসে সার্টিফিকেশন আইনের খসড়াটি সবার মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়।
এ দুই বছরে দেশে-বিদেশে বেড়েছে ওভার দ্য টপের (ওটিটি) বা ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের দাপট। ওটিটি পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদা একটি নীতিমালা প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে সরকার। শুরু হয়ে গেছে নীতিমালার খসড়া তৈরির কাজও।
সেন্সর সার্টিফিকেশন আইনটি খসড়া থেকে চূড়ান্ত হওয়ার কোন পর্যায়ে আছে জানতে যোগাযোগ করা হয় তথ্যসচিব ও চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি যখন হবে তখন জানতে পারবেন। এটি নিয়ে আমার কথা বলা উচিত নয়।’
সেন্সর সার্টিফিকেশন আইনটি কোন পর্যায়ে আছে তার একটি ধারণা পাওয়া যায় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিনের কাছ থেকে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি মূলত তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। আমার জানা মতে এটি এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে।’
চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সচিব মো. মমিনুল হক জানান, সম্প্রতি তারা সেন্সর সার্টিফিকেশন আইনের খসড়ার ৮০টিরও বেশি কপি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
সার্টিফিকেশন আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে থাকা মানে, যেকোনো সময় আইনটি মন্ত্রিসভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে। সেখানকার সম্মতি পেলে আইনটি পাস করার জন্য উত্থাপিত হবে সংসদে।
তবে এসব ব্যাপারে সেন্সর বোর্ড সদস্যরাও তেমন কোনো আলোচনা শোনেন না বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, পরিচালক ও সেন্সর বোর্ডের সদস্য অরুণা বিশ্বাস। তিন বছর ধরে সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে অরুণা বিশ্বাস বলেন, ‘সেন্সর সার্টিফিকেশন বা গ্রেডেশন পদ্ধতি চালু হওয়ার বা আইনটি পাস হওয়ার কোনো আলোচনা শুনিনি। অনেক দিন ধরেই তো কাজ করছি। গ্রেডেশন পদ্ধতি চালু হলে ভালো হতো।’
চারটি শ্রেণি বা গ্রেড
নতুন আইনের খসড়ায় চলচ্চিত্রকে চারটি শ্রেণিবিন্যাসে মূল্যায়ন করা হবে।
একটি শ্রেণিকে বলা হবে ‘ইউএ’ (সর্বজনীন দর্শক)। এ ছবি হবে সব বয়সী দর্শকের দেখার উপযোগী। এই গ্রেডের চলচ্চিত্র হবে মূলত সামাজিক ও পারিবারিক কাহিনিনির্ভর।
এসব চলচ্চিত্রে এমন কোনো উপাদান থাকবে না, যা দেখলে পিতা-মাতা বিব্রত বা অসন্তুষ্ট হতে পারেন। এতে হালকা সংঘর্ষ বা রসিকতা থাকতে পারে। এতে কোনো নগ্নতা, যৌনতা, হিংস্রতা কিংবা অশালীন ভাষার ব্যবহার থাকবে না। কাহিনির প্রয়োজনে ধূমপান বা মাদক গ্রহণের দৃশ্য দেখাতে হলে সতর্কীকরণ বক্তব্য থাকতে হবে। সহিংসতা বা ভীতিকর দৃশ্য থাকলে তা হতে হবে স্বল্প পরিসরে।
‘ইউ-১২’ গ্রেডের সিনেমা ১২ বছরের কম বয়সী শিশুরা কেবল পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সঙ্গে দেখতে পারবে। এটি মূলত শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এতে হালকা ভীতিকর দৃশ্য থাকতে পারে।
‘ইউ ১২-১৮’ গ্রেডের সিনেমাগুলো ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোররা দেখতে পারবে। এ ধরনের চলচ্চিত্রে হালকা ভীতিকর দৃশ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া স্বল্প মাত্রায় সহিংসতা ও রোমান্টিকতা থাকতে পারে।
‘ইউ ১৮+’ গ্রেডের সিনেমাগুলো ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সীরা দেখতে পারবেন। এ ধরনের চলচ্চিত্রে পরিমিত মাত্রায় সন্ত্রাস, ভয়াল দৃশ্য, যৌনতা ও বিধি অনুযায়ী সতর্কীকরণ বক্তব্যসহ মাদকের ব্যবহার থাকতে পারে।
আইনে সার্টিফিকেট সাময়িক স্থগিত করা সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়েছে, সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান যদি মনে করেন যে, একটি সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত সিনেমা বাংলাদেশের ভেতরে প্রদর্শন উচিত না, তা হলে তিনি আদেশ জারির মাধ্যমে সাময়িকভাবে সার্টিফিকেট স্থগিত করতে পারেন।
যদি কোনো জেলা প্রসাশক মনে করেন যে, তার এলাকায় কোনো সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত সিনেমা প্রদর্শন উচিত না, তাহলে তিনি আদেশ জারির মাধ্যমে তার জেলার সীমানার মধ্যে সেই ছবির সার্টিফিকেট বাতিল করতে পারেন।
আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে, স্থানীয় চলচ্চিত্রশিল্পের স্বার্থে অথবা যেকোনো জাতীয় স্বার্থে একটি সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেট আদেশ জারির মাধ্যমে সার্টিফিকেট বাতিল করা যাবে।
সেন্সর সার্টিফিকেশন আইনের খসড়া প্রকাশের পর ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি)-এর আয়োজনে প্রস্তাবিত ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’-এর খসড়াপাঠ ও বিচারবিষয়ক একটি জাতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে প্রস্তাবিত আইনটি ‘দমনমূলক’ বলে অভিযোগ করেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকর্মীরা।
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহারের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের ৪০টি চলচ্চিত্র সংসদের প্রতিনিধি এবং তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, চলচ্চিত্র গবেষক।
সভায় এফএফএসবি ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়েত হোসেন মামুন বলেন, ‘আইনের একটি প্রধান সমস্যা হলো, এই আইনগুলো সবই প্রণীত হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের স্বাধীনতাকে সীমিত করবার অভিপ্রায়ে। এই আইনটির মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা বা কর্মীর মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়েছে, যা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’