ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আগস্ট মাসে মুক্তি পেয়েছে সিনেমা নীল মুকুট। সিনেমাটির মাধ্যমে চিত্রের নতুন ভাষায় কথা বলতে চেয়েছেন পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন।
সিনেমাটি দেখার পর এর নির্মাণপদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে জানার ইচ্ছা হয়েছে অনেকের। অনেক দর্শক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সিনেমাটির বিষয়বস্তু নিয়ে।
এমন কিছু বিষয় নিয়ে পরিচালক কামার আহমাদ সাইমনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
- কামার আহমাদ সাইমন। আপনার নামে তিনটি শব্দ। আপনার কাছের মানুষরা কোন শব্দটি বেছে নেন আপনাকে ডাকার ক্ষেত্রে। আমরাও আপনাকে সেই নামে সম্বোধন করতে চাই। আপনার কাছের হওয়ার খায়েশ আছে আমাদের।
দশ-বারো বছর স্কুলের যে জীবনটা যায়, যেখানে আমার নাম কামার এবং কামার নামেই সেখানে সবাই আমাকে ডাকে। কামার একটি আরবি শব্দ এবং এটা নিয়ে অনেক সময় আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে। ছোটবেলায় বন্ধুরা যখন কামার বলে ক্ষ্যাপাত তখন খুব মন খারাপ হতো।
পরে বুয়েটে গিয়ে সাইমন নামটা আমি বেশি ব্যবহার করেছি। বুয়েট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর একটা অন্য চিন্তায় কামার নামটি আবার ব্যাক করে। তখন আমি আবার কামার নামটি বলা শুরু করি।
যখন দেখলাম ছবি বানাতে যাচ্ছি, তখন দিনরাত যে অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যাই, তখন নিজেকে কামারবাড়ির সেই হাঁপর চালানো মানুষটার সঙ্গে মিল খুঁজে পাই। আমাদের চলচ্চিত্রযাত্রাটা অনেকটা সে রকমই।
কামারশালায় সিনেমা যাপন বলে একটি ব্লগ লেখা শুরু করি এবং কামার নামটাকে রি-ডিসকভার করা শুরু করি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হব যদি কেউ আমাকে কামার নামে ডাকে।
চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানে কথা বলছেন কামার আহমাদ সাইমন। ছবি: সংগৃহীত- আপনার সিনেমার প্রসঙ্গে আসি। আপনার পরিচালিত সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমার নাম নীল মুকুট। নীল রঙের মুকুটটাই কেন পরাতে চাইলেন আপনি?
আমি সিনেমায় যে বর্গকে নিয়ে কাজ করেছি, তাদের পোশাকের মধ্যে নীল রঙের প্রাধান্য রয়েছে। তারা যে মিশনে গিয়েছে, সেখানেও একটি নীলের ব্যাপার আছে। এ দুটি বিষয় হলো আক্ষরিক অর্থে সিনেমার নামকরণ নীল মুকুট করার কারণ।
কিন্তু যদি একটু ভেতরের দিকে তাকাই। নীলের মধ্যে ব্যথার একটা প্রকাশ আছে, কবিতায় এই বিষয়টি প্রকট, ওই জায়গা থেকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল নীল মুকুটটা বেশি অ্যাপ্রোপিয়েট।
মুকুটটা যে আপনি পরলেন সেটা আনন্দে পরলেন, না বেদনায় পরলেন সেটার একটা ব্যাপার আছে। যে পাওয়ারের জন্য মুকুটটা পরা হলো, সেটা কি তিনি কনজিউম করলেন, এমন একটি প্রশ্ন আমার সিনেমার মধ্যেও আছে।
আমার কাছে মনে হয়েছে সিনেমাটি একটু বেদনাতুর, একটু নীলচে, সেখান থেকেই সিনেমার এমন নামকরণ।
- পোস্টারে দেখেছি নীল মুকুট সিনেমাটিকে বলা হচ্ছে ডকু-ড্রামা।
না, পোস্টারে কোথাও মনে হয় এমন লেখা নাই। প্রেসে অনেক জায়গায় নীল মুকুটকে ডকু-ড্রামা বলা হয়েছে।
- আপনি নীল মুকুটকে কী বলতে চান?
আমি এটাকে সিনেমা বলতে চাই। নীল মুকুট যেহেতু রানিং সিনেমা, এর অনেকগুলো মিথ আছে। সেগুলো আমি এখনও ভেঙে দিতে চাই না।
সিনেমা বানাতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে সিনেমার প্রয়োজনে যেখানে আমার ফিকশন লাগবে সেখানে ফিকশন, যেখানে ড্রামা লাগবে সেখানে ড্রামাটাইজ করব, যেখানে আমার ডকুমেন্ট্রি লাগবে, সেখানে আমি ডকুমেন্ট্রি ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করব।
- প্রচলিত ধারণায় সিনেমা নির্মাণ করতে গেলে অবশ্যই তার একটি স্ক্রিপ্ট লাগবে। নীল মুকুটের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ছিল কি না?
প্রচলিত অর্থে সিনেমার যে সিন বাই সিন সাজানো, সংলাপ সেসব আমার শুনতে কি পাও, নীল মুকুট বা যে সিনেমাটি আসছে অন্যদিন বলে, সেখানে এমন স্ক্রিপ্ট নাই।
একই সঙ্গে উল্টোটাও বলি, কোনোটাই কাগজের বাইরে নয়। অনেক অনেক প্ল্যানিং, সেগুলো লেখা এবং শুট করার সময় আমরা চাচ্ছি যে এখানে এই আলোচনা থাকবে, এখানে চরিত্রগুলো এমন করবে।
মজাটা কিন্তু সেখানেই, যেখানে দর্শকের দেখে মনে হবে আমি কিছু করি নাই কিন্তু আমি মূলত অনেক কিছু করেছি। সাজানো তো সেটাই সুন্দর, যেটা দেখে আপনাকে সুন্দর লাগবে কিন্তু মনে হবে না যে আপনি সেজেছেন।
- যদি ধারণা করে বলি, যে ঘটনা যেভাবে গেছে ক্যামেরা বা পরিচালক সেইভাবেই এগিয়ে গেছেন। সেখানে পরিচালকের আসলে কী করার ছিল?
যেটা ঘটছে সেটাই যদি আমি ক্যামেরায় ধরি, তাহলে তো আমার কোনো কাজ নাই।
শুটিং এর সময় কামার ও তার ইউনিট। ছবি: সংগৃহীত- এটা আমাদের বিস্ময় বলতে পারেন যে, কামার কি আসলে ঘটনার পেছনে দৌড়াল, নাকি ঘটনা তৈরি করে তার পেছনে দৌড়াল?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেফিনেটলি আমি ঘটনার পেছনে দৌড়াইছি। যেমন সিনেমায় একটি ছাগলের সিকোয়েন্স আছে, সেটা শুট করতে আমি ছাগলের পেছন পেছন দৌড়াইছি।
এমন অনেক ব্যাপার আছে যা যেভাবে এসেছে আমি সেভাবে নিয়েছি। বলতে পারেন জীবনের রস চুরি করেছি। আর অনেক কিছু প্ল্যান করে নেয়া কিন্তু সেগুলো আমি বলতে পারব না কারণ সেই মিথটা আমি ভাঙতে চাই না।
- নীল মুকুট সিনেমায় সচেতনভাবে আপনার কিছু ফুটিয়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল কি?
হ্যাঁ, একটা বিষয় তো সাংঘাতিকভাবে ছিল। এই পোশাক পরা মানুষগুলো সম্পর্কে সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমার যে পারসপেকটিভ, যেখান থেকে আমি একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম।
এই গল্পটা অনেক জায়গায় বলেছি। আমি বিমানে হঠাৎ করে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সেটা ট্র্যাক করে দেখলাম যে একজন ইউনিফর্ম পরা মানুষ কাঁদছেন। ওই দৃশ্যটা দেখে আমার সিনেমাটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত।
আমার মনে হয় সেটা আমারই সীমাবদ্ধতা যে, আমি ভেবে নিয়েছিলাম ইউনিফর্ম পরা একজন সে তো মানুষ না। সে কেন কাঁদবে বরং আমি তাকে দেখে কাঁদব। এই যে একটা ভুল ধারণা, সেটা আমাকে ভীষণভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
ধরেন শাহবাগে যে পুলিশ আমাকে লাঠিচার্জ করে সে তো আসলে বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। সে তার পরিবারের কাছে যেতে চায়। পারে না, কারণ তাকে ওই কাজটি করতে বলা হয়েছে। যিনি বলেছেন, তিনি আবার তার ওপরের কারও কাছ থেকে সে কাজের নির্দেশ পেয়েছেন।
এখন যে লাঠিচার্জ করে আর যে লাঠির বাড়ি খায়, দুজনেই একই শ্রেণির মানুষ। কিন্তু আমরা যারা লাঠির বাড়ি খাই, তারা অলিক একটা কিছু ভেবে লাঠিচার্জকারীদের শত্রু বানিয়ে ফেলি।
কিন্তু তারা যে আমাদের মতোই, তাদের পরিবার আছে, হাসি-কান্না আছে, আমি সচেতনভাবে সেটাই দেখাতে চেয়েছি।
- সে ক্ষেত্রে দেশের বাইরে যাওয়ার সুবিধা কী?
ঢাকা শহরে গত বিশ বছরে আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, তারা তো এই বাস্তবতা মেনেই বড় হয়েছি যে চাইলেও পুলিশের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না আপনি। এটা নির্মম বাস্তবতা। আমি কালকে যদি আরেকটি কাজের কথা বলি, পুলিশ সেই সুযোগ আমাকে চাইলেও দিতে পারবে না।
বাইরে যাওয়াটা আসলে একটা সুযোগ। কৌশলগতভাবে আমি সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি। এসব অনুমতি পেতে অনেক কাঠ-খর পোড়াতে হইছে।
বাইরে যাওয়ার কারণে আরেক সুবিধা হইছে। সেটা হলো, আমি যে বিষয়টা তুলে ধরতে চাচ্ছিলাম, দূরত্বের কারণে সে পরিস্থিতিটা তৈরি করছে।
- ইউনিফর্ম পরা মানুষগুলো বিদেশে গিয়েছে। সেখানে তাদের দক্ষতা বা চৌকস ভাবটাও তুলে আনার কোনো সুযোগ ছিল কি?
কোনো সিনেমা কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো চিত্র দেয়ার জন্য তৈরি হয় না। যদি সেটা করা হয় তাহলে সেটা প্রপাগান্ডা সিনেমা। যদি আমি পূর্ণ চিত্র দেই তাহলে মনে হবে যে আমি পেইড। আমার সেটা উদ্দেশ্য ছিল না এবং আমি পেইডও নই। আমার ভিন্ন একটা অবজেকটিভ ছিল, সেটি আমি পূরণ করার চেষ্টা করেছি।
কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নবীন পরিচালকদের সঙ্গে কামার আহমাদ সাইমন। ছবি: সংগৃহীত- প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমা দেখলে নিজেকেই যেন ছোট মনে হয়। আবার ছোট স্ক্রিনে কিছু দেখলে বড় বিষয়কেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। নীল মুকুটের ক্ষেত্রে এমন কিছু মিস হলো কি না দর্শকদের?
ঠিকই বলেছেন। থিয়েটারে বসে নীল মুকুট দেখলে আপনার ওপর যে আসরটা হবে সেটা তো ওটিটি দিয়ে সম্ভব না। এ ছাড়া এই কনটেন্টে ৫ দশমিক ১ সিস্টেমে সাউন্ড মিক্স করা। এটার তো কোনো কাজেই লাগল না। ওটিটিতে একটা স্টেরিও সাউন্ড হয়তো আপনারা পেয়েছেন।
- ওটিটির কারণে নতুন দর্শক তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করছি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সিনেমাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা এসেছে।
এটা ঠিক। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক জায়গায় সিনেমাটি নিয়ে লাইভে যুক্ত হতে হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে চলচ্চিত্র সংসদ রয়েছে, সেই দর্শকরা আমাকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
ওটিটির জন্য আরেকটি সুবিধা হয়েছে। যেহেতু সিনেমায় কোনো স্টার কাস্ট নেই, তাই নীল মুকুট চালানোর জন্য বেশি একটা হল পাওয়া যেত না। কিন্তু ওটিটিতে মুক্তি পাওয়ার কারণে অনেকে সিনেমাটি দেখতে পেয়েছেন।
- চলচ্চিত্রের এমন ভাষায় বেশি সিনেমা আশা করছি না কিন্তু অল্প সিনেমাও দেখা যায় না। এভাবে ভাবা যাচ্ছে না, এটাই কি শুধু কারণ?
আমার চলচ্চিত্রযাত্রা খুব বেশি দিনের না, দশ-এগার বছরের একটা যাত্রা। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন আমি এই প্রশ্ন নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। আমার জনপদের সিনেমা কেমন হবে বা আমার সময়ের সিনেমার ইমেজটা কেমন হবে। এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে আমার চলচ্চিত্র প্রস্তুতিতে আমি সম্পূর্ণভাবে ঋণী আমার সাহিত্যের কাছে।
ধরেন আমি যদি সৈয়দ ওয়ালীউল্লার লাল সালু পড়ি বা অদ্বৈতমল্ল বর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটা পড়ি বা আমি যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটা পড়ি তাহলে যে ইমেজগুলো পাই, যে ম্যাটেরিয়াল পাই, সিনেমায় এই ইমেজগুলোর সাংঘাতিক সংকট ছিল এবং আছে এখনও।
আমাদের গল্পের শূন্যতার একটা মৌলিক কারণ হচ্ছে, আমার যেটা মনে হয়, গত দুই দশক ধরে যারা সিনেমার চর্চার মধ্যে এসেছেন, তাদের সবার ওপর ইরানিয়ান, কোরিয়ান বা লাতিন সিনেমার প্রভাব রয়েছে। সেটা আমার ওপরও আছে।
কিন্তু তারা আমার কাছে মনে হয়েছে যে একটা রি-প্রোডাকশনের দিকে চলে গেছেন। এমন হয়তো হয়েছে যে আমি অরেকটি ইরানিয়ান, কোরিয়ান বা লাতিন সিনেমা বানাব। কিন্তু প্রয়োজন ছিল আরেকটা বাংলাদেশি সিনেমা বানানো।
শুনতে কি পাও সিনেমা নির্মাণের পর কামার। ছবি: সংগৃহীত- নীল মুকুট দেখার পর অনেকেই আপনার কাজ খুঁজছেন হয়তো। নতুন কাজ কবে দেখতে পাবেন দর্শকরা?
আমার দুটি সিনেমার কাজ শেষ। একটি শিকলবাহা, আরেকটি অন্যদিন। এর মধ্যে অন্যদিন ও শুনতে কি পাও সিনেমাটি পরপর শুরু করি। অনেকের হয়তো এখন মনে নেই অন্যদিনের কথা।
শুনতে কি পাও, অন্যদিন এবং আরও কিছু জীবন এই তিনটি মিলে ট্রিলজির প্ল্যান ছিল এবং আমার পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে তৃতীয় সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার। সে অনুযায়ী আমি অন্যদিনের শুটিং শেষ করে ফেলেছিলাম ২০১৬-১৭ সালের দিকেই কিন্তু একটু বিচিত্র ঘটনার কারণে প্রায় পুরো শুটিংটা করার পরেও আমার রেখে দিতে হয়েছে। আশা করছি আগামীতে সিনেমাটি দর্শকরা দেখতে পাবেন।