যাত্রা শুরু একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। এরপর তা রূপ নেয় সংগঠনে, হয়ে ওঠে একটি সাহিত্য আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনেও রয়েছে এর অনন্য ভূমিকা। এটি সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, যা কেমুসাস নামে সুপরিচিত।
এই অঞ্চলের সাহিত্য চর্চা ও পাঠাভ্যাস তৈরিতে ৮৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠন। ১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় এটি। দেশের প্রাচীনতম এই সাহিত্য সংগঠন এখন সিলেটের ঐতিহ্যেরই অংশ।
১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। তখন ভারত-পাকিস্তান সবেমাত্র আলাদা হয়েছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা চূড়ান্ত হয়নি। ওই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে।
এ অঞ্চলের ইতিহাসবিদদের মতে, এটিই রাষ্টভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম কোনো সভা। এরপর ৩০ নভেম্বর নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আরেকটি আলোচনা সভার করে সংগঠনটি। সেখানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।
উর্দুর সমর্থকরা হামলা চালিয়ে এই সভা পণ্ড করে দেন। এর প্রতিবাদে রাজপথেও নামেন বাংলা ভাষার সমর্থকরা। সভায় পাঠ করা মুজতবা আলীর সেই প্রবন্ধ পরবর্তী সময়ে ছাপা হয় সাহিত্য সংসদের নিয়মিত প্রকাশনা ‘আল ইসলাহ’-তে।
এই আল ইসলাহর মাধ্যমেই ১৯৩৬ সালে যাত্রা শুরু হয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের।
সংগঠনসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ১৯৩২ সালে ‘অভিযান’ নামের একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হক। সে বছরই এর নাম বদলে রাখা হয় ‘আল ইসলাহ’।
আল ইসলাহকে কেন্দ্র করে সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার বছর পর ১৬ সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগার মোতাওয়াল্লি সরেকওম আবু জাফর আব্দুল্লাহর বাড়ির বৈঠকখানায় আলোচনায় বসেন কবি নূরুল হক। সেদিনই সংগঠন হিসেবে জন্ম নেয় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট বা কেমুসাস।
সেখানে মরমী কবি হাসন রাজার ছেলে দেওয়ান একলিমুর রাজাকে সভাপতি এবং দরগা শরিফের আবু জাফরকে সম্পাদক করা হয়। পরে কবি নূরুল হক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।
এই সংগঠনের বর্তমান কমিটির সদস্য ও আল ইসলাহের প্রাক্তন সম্পাদক কবি আব্দুল মুকিত অপি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অবিভক্ত ভারতে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন। তাদের দমিয়েও রাখা হতো। মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই তৎকালীন অগ্রসর চিন্তার মানুষজন মিলে গঠন করেছিলেন এই সাহিত্য সংসদ।’
অপি জানান, প্রথমে দরগা শরিফের মোতাওয়াল্লি আবু জাফরের বাড়ির পাশের একটি ঘরে ছিল সংগঠনটির কার্যালয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবু জাফর, আমীনুর রশীদ চৌধুরীসহ সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রচেষ্টায় দরগার পাশে জমিতে স্থানান্তর হয় সাহিত্য সংসদের কার্যালয়। এখন সেখানে নির্মিত হয়েছে সংগঠনটির বহুতল ভবন।
অপি আরও জানান, মাত্র ১৯টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কেমুসাসের পাঠাগারের। এখন তাতে আছে অর্ধলক্ষাধিক বই। দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য কিছু বই এবং শিলালিপিও সংরক্ষিত আছে সেখানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতের লেখা কোরআন শরীফ।
কার্যালয়ের পঞ্চম তলায় সাহিত্য সংসদের সাবেক সভাপতি ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদের নামে চার হাজারেরও বেশি সংগ্রহ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি জাদুঘরও আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সুলেমানের নামে একটি মিলনায়তনও করা হয়েছে।
শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই পাঠাগার। পাঠকদের আনাগোনায় জমজমাট থাকে প্রায় প্রতিদিনই।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি জসীমউদ্দীন, শেরেবাংলা এ কে ফজুলল হক, কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সঙ্গীতজ্ঞ আব্বাস উদ্দিন, কবি সুলতানা কামাল, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, বাউল শাহ আবদুল করিমসহ অনেক বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের পদচারণে হয়েছে এই সাহিত্য সংসদে।
কেমুসাসের সভাপতির দায়িত্বে এখন আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সংসদের সহসভাপতি সেলিম আউয়াল বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিকাশে কেমুসাস অনন্য অবদান রেখে চলছে। এর মুখপত্র আল ইসলাহ ৮৫ বছর ধরে প্রায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আল ইসলাহে সম্পাদকীয় লেখা হয়।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১৯৪৩ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসায় অর্থ সহায়তার জন্য ‘নজরুল সাহায্য ভান্ডার’ গঠন করে কেমুসাস। এ দেশে প্রথম নজরুল সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনও করে এই সংগঠন। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেখানে বসে সাহিত্য আসর। জেলার সাহিত্যপ্রেমীরা সেখানে আড্ডায় মেতে ওঠেন।
সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০০১ সাল থেকে ‘কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার’ দিয়ে আসছে এই সংগঠন। জ্ঞানচর্চায় ও সমাজসেবায় অবদানের জন্যে প্রতিবছর একজন বা দুইজনকে সাহিত্য সংসদের ‘সম্মানসূচক সদস্য পদ’ দেয়া হয়।
নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতি, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রতি বছর এই সংগঠন তাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এই কর্মসূচির নাম দেয়া হয়েছে ‘শেকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা’।
এছাড়া, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর বসে ‘কেমুসাস বইমেলা’।
সংসদের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছড়াকার রিপন আহমদ ফরিদী বলেন, ‘তৎকালীন প্রেক্ষাপটের কারণে এই সংসদের নাম মুসলিম সাহিত্য সংসদ রাখা হয়েছিল। তবে এখন এর সঙ্গে সব ধর্মের মানুষই সম্পৃক্ত। সাহিত্যচর্চা ও মানুষের পাঠাভ্যাস তৈরিতে সব সময়ই কাজ করে যাবে এই সংসদ।’