বিকেল ঠিক ৪টা। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার উষ্টি বিএস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের চারপাশে জড়ো কয়েক হাজার দর্শক। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী ‘পাতা খেলা’ উপভোগের অপেক্ষায় সবাই।
সুসজ্জিত মাঠে ১৩ জন তান্ত্রিক এবং ‘পাতা’ হিসেবে পাঁচ জনের অংশগ্রহণে শুরু হয় টানটান উত্তেজনার খেলা। নিয়ম অনুযায়ী, তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে পাতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন ১৩ তান্ত্রিক বা ওঝা। মন্ত্রের শক্তিতে পরাস্ত হয়ে কোনো পাতা নির্ধারিত দাগের বাইরে বেরিয়ে এলে জয়ী হবেন মন্ত্র উচ্চারণকারী সংশ্লিষ্ট তান্ত্রিক। আর মন্ত্রের শক্তিকে দমন করে কোনো পাতা নিজের সীমানায় অটল থাকলে বিজয়ী হবেন তিনি।
দর্শকের তুমল করতালির মধ্যে শনিবার বিকেলে শুরু হয় খেলা। এতে ‘তন্ত্রমন্ত্র মন্ত্রী’ বা তান্ত্রিক হিসেবে অংশ নেন নজরুল ইসলাম, সারোয়ার হোসেন, বেলাল হোসেন, আকবর আলী, রতন আলী, লুৎফর রহমান, খাদেমুল ইসলাম, সেকেন্দার আলী, মাহাবুর রহমান, সোলাইমান আলী, জুয়েল রানা, লাবিব হাসান ও নুরুল ইসলাম।
পাতা হিসেবে অংশ নেন আব্দুল খালেক, আতোয়ার হোসেন, সবুজ হোসেন, লোকমান আলী ও শাহাজান আলী।
বেসরকারি সংস্থা দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের অনুপ্রেরণায় তৈরি ছাত্র সংগঠন ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার আকবরপুর ইউনিয়ন ফোরাম এবং পত্নীতলা উপজেলা ফোরাম আয়োজন করে খেলাটি।
খেলার জন্য মাঠের মাঝখানে পুঁতে রাখা হয় কলাগাছের গোড়ায় পানিভর্তি মাটির ঘটি। এর চারপাশ চুন দিয়ে বৃত্ত আঁকা। গোটা মাঠটিতেও বৃত্তাকারে চিহ্নিত করা। খেলার শুরুতেই ১৩ তান্ত্রিক মাটির ঘটির পানিতে হাত ভিজিয়ে নেন। এর পর মাঠের বিভিন্ন অংশে অবস্থান নিয়ে মাটিতে হাত রেখে মন্ত্র জপতে শুরু করেন।
অন্যদিকে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ পাতা মাটিতে হাত রেখে অনড় অবস্থান নেন। তাদের সবার লক্ষ্য, কোনোভাবেই যাতে তান্ত্রিকের মন্ত্রে মনভোলা না হন। ধীরে ধীরে জমে ওঠে খেলা। বিকেল গড়িয়ে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। যে সব ওঝা তাদের মন্ত্রে পাতাদের পরাস্ত করেছেন বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তাদের।
উষ্টি গ্রামের সেকেন্দার আলীর পরিচালনায় টানা প্রায় ২ ঘণ্টার খেলায় মহাদেবপুর উপজেলার নজরুল ইসলাম দুটি পাতার মন ভুলিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। আর একটি করে পাতাকে আকৃষ্ট করে যৌথভাবে রানার আপ হন পত্নীতলা উপজেলার মাটিন্দর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের সারোয়ার হোসেন, আকবরপুর ইউনিয়নের বড়মহারন্দি গ্রামের সেকেন্দার আলী এবং মধইল গ্রামের মাহাবুর রহমান।
খেলা শেষে অশংগ্রহণকারী সব পাতাকে গামছা, সাবান এবং নারকেল উপহার দেয়া হয়। এছাড়া প্রত্যেক তান্ত্রিককে নারকেল এবং চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপদের এলাকার ঐতিহ্য মেনে এক ডজন করে নারকেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। অংশ নেয়া সবাই পেয়েছেন বিশেষ পরস্কারও।
চ্যাম্পিয়ন নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর থেকে এই খেলা খেলছি। শুধু নওগাঁ নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। এখন আর আগের মতো তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলার আয়োজন হয় না।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্র বা বান দিলে সেই বানটি আবার ফেরত আনা যায়। ফলে এই বানে কারো কোনো ক্ষতি হয় না।’
পাতা হিসেবে অংশ নেয়া আব্দুল খালেক বলেন, ‘ওঝা বা তান্ত্রিকরা যখন মন্ত্র পড়েন তখন নিজের মন ঠিক রাখা খুব কঠিন হয়ে যায়। অনেকদিন পর এমন খেলায় অংশ নিতে পেরে খুব ভালো লেগেছে।’
পাতা খেলার বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়ার জন্য রাখা নারকেল
নওগাঁর স্থানীয় লেখক, গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নওগাঁতে প্রায় শত বছর আগে এই খেলার প্রচলন হয়। পাতা খেলাটি এক ধরনের ব্ল্যাকম্যাজিক। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম রাজ্য থেকে খেলাটি আমাদের দেশে এসেছে। দেশ স্বাধীনের পর নওগাঁতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় এই খেলা হতো। এখন দুই-এক জায়গায় মাঝে-মাঝে হয়ে থাকলেও আগের মতো বড় পরিসর নেই।’
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের পত্নীতলা এলাকার সমন্বয়ক আসির উদ্দীন বলেন, ‘গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতেই আমাদের এই আয়োজন। আমরা চাই সামাজিক সম্প্রীতি অটুট রেখে সহনশীলতার চর্চা অব্যাহত থাকুক।’