পর পর দুই টি-টোয়েন্টি জিতে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদেরকে আগেই আন্ডারডগ বানিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। সিরিজ রক্ষার ম্যাচের চেয়ে অজিদের কাছে তৃতীয় এই টি-টোয়েন্টিটা ছিল সম্মান বাঁচানোর লড়াই। তবে সফলকাম হলো না এবারও।
মিরপুরের শের-ই-বাংলায় জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে তৃতীয় ম্যাচে মাঝেমধ্যে উজ্জ্বলতা ছড়ানো অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত হেরেই গেল। আর ৫ ম্যাচের সিরিজে অবিশ্বাস্যভাবে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ও স্পিকার।
করোনাকালে বাংলাদেশ সফরে এসে শর্তের পর শর্ত দিয়ে আলোচনায় এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সব মেনেই আসতে দিয়েছে বাংলাদেশ। যেন পরিকল্পনাটি ছিল মাঠেই জবাব দেয়ার।
হলোও তাই। প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে ১৩১ রান করে অস্ট্রেলিয়াকে ১০৮ রানে বেঁধে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম জয়টা পেয়েছিল টাইগাররা।
দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার টসে জিতে আর বাংলাদেশকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর ঝুঁকি নেয়নি। কিন্তু তাতে ম্যাচের ফলাফল পাল্টেনি। এবার বাংলাদেশ জিতল পরে ব্যাটিং করে, পাঁচ উইকেটে।
তখন অস্ট্রেলিয়ার কাছে তৃতীয় ম্যাচ হয়ে পড়ে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে। আর বাংলাদেশ টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয়। মন্থর উইকেটে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশের দুই ওপেনার।
এবারও ফলাফল, ছোট স্কোর করেও সফরকারীদের বেঁধে রাখা।
বাংলাদেশ ২০ ওভারে তুলেছিল ১২৭ রান। ৬ এর কিছু বেশি আস্কিং রেট তাড়া করতে গিয়ে এক পর্যায়ে ১ উইকেটে ৭১ রান তুলে ফেলার পরেও সফরকারীরা হারল ১০ রানে।
ম্যাচে চরম উত্তেজনা দেখা দেয় শেষ ওভারে। তখন ২২ রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনা দেখাতে পারবে, এমনটি ধারণাও ছিল না। তবে প্রথম বলে অ্যালেক্স ক্যারি ছক্কা মেরে তরুণ মাহেদী হাসানকে চাপে ফেলে দেন।
তবে দ্বিতীয় বলে ১ আর তৃতীয় বল ডট দেয়ার পর নিয়ন্ত্রণ আবার বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসেন তরুণ টাইগার। তবে ৩ বলে দরকার ১৫, এই অবস্থায় আবার একটি নো বল করে বসেন তিনি। সেই বলে হয় আরও একটি রান।
ফলে তিন বলে তখন দরকার হয় ১৩। ভীষণ চাপ। কিন্তু এরপর ভেলকি দেখান মাহেদী। কিন্তু ‘ফ্রি হিটের’ বলটি রাউন্ড দ্য ইউকেটে এসে ব্যাটসম্যান ক্যারির বুটের কাছাকাছি ফেলেন। যেভাবেই মারেন আউট হবেন না, এমন বলে সপাটে চালাতে পারেননি ব্যাটসম্যান। আসে ১টি রান।
২ বলে দরকার দুই। জিততে হলে মারতে হবে দুটি ছক্কা। ক্রিজে ড্যান ক্রিশ্চিয়ান। ফুল লেংন্থে ব্যাটসম্যানের একটু নাগালের বাইরে জোরের ওপর দেন মাহেদী। সপাটে চালাতে এবারও ব্যর্থ। রান হয়নি একটিও।
এক বলে দরকার ১২। নো বা ওয়াইড না হলে ম্যাচ বাংলাদেশের। এই অবস্থায় কোনো ঝুঁকি না নিয়ে মাহেদী সোজা বল দিলেন। একেবারে ফ্ল্যাট ডেলিভারি। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চাপের কারণেই কি না, এবারও বলকে সীমানায় পাঠাতে ব্যর্থ ক্রিশ্চিয়ান। রান হলো একটি মাত্র। ফল বাংলাদেশের জয় ১০ রানে।
করোনার কারণে খালি স্টেডিয়ামে সিরিজ জেতার আনন্দটা পূর্ণাঙ্গ হয়নি। যা কিছু উল্লাস, তার সিংহভাগই তখন টেলিভিশনের সামনে।
তবে টাইগাররা তখন গর্জন করছে মাঠে। তাদের আনন্দ বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো আছড়ে পড়েছে মাঠে। উল্টো চিত্র অজি শিবিরে। অতীতে একবার ওয়ানডে আর একটি টেস্টে হারা দলটি বাংলাদেশকে কোনো টি টোয়েন্টিতে এর আগে পাত্তাও দেয়নি। সেই তাদের কাছেই পরপর তিনটি ম্যাচের পরাজয় যেন হজম হচ্ছিল না সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
কিন্তু মেনে না নিয়ে উপায় নেই। আর হতাশার ছাপ তখন সফরকারীদের চোখে মুখে স্পষ্ট। মাথা নুইয়ে মাঠ থেকে বিদায় হন তারা।
ম্যাচের নায়ক নিঃসন্দেহে টাইগার অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। কঠিন উইকেটে এক প্রান্ত আগলে ধরে তার অমূল্য ৫১ রানেই লড়াইয়ের স্কোরটি করেছিল স্বাগতিকরা। ম্যান অব দ্য ম্যাচও উঠে তার হাতেই।
বোলিংয়ে সেরা পেইসার শরীফুল ইসলাম। তবে ২টি উইকেট শিকার করলেও তিনি রান দিয়ে বসেন ২৯। এই উইকেটে যেটি একটু বেশিই বলা যায়।
উইকেট নেওয়ার পর উচ্ছ্বসিত শরীফুল ইসলাম। ছবি: এএফপি
তবে বোলিংয়ের নায়ক বলতে হবে মুস্তাফিজকে। কিপটেমি বলতে কী বোঝায় তা করে দেখিয়েছেন তিনি। ২৪ বলে ১৫টি ডট বল, ২ ওভারে যখন দরকার ২৩ রান, তখন তার ৫টি ডটবল বাংলাদেশকে বলীয়ান করে। ওই ওভারে হয় মাত্র ১ রান।
প্রথম ম্যাচে চার উইকেট শিকার করে নায়ক নাসুম আহমেদ শুরুর উইকেটটি পেলেও পরে আর কাউকে সাজঘরে ফেরাতে পারেননি। ৪ ওভারে রান দেন ১৯টি।
সাকিব আল হাসান ২২ রান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিকার করেন একটি উইকেট। আর সৌম্য এক ওভারে দেন ৯ রান।
১২৮ রান তাড়ায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেট পড়ে ৮ রানে। অধিনায়ক ম্যাথিউ ওয়েডকে ফেরান নাসুম আহমেদ। এরপর অবিশ্বাস্য এক জুটি গড়েন মিচেল মার্শ ও বেন ম্যাকডারমট। তারা স্কোর নিয়ে যান ৭১ রানে।
তখন ওভার চলে ১৪ তম ওভার। আক্রমণে এসে ম্যাকডারমটকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান সাকিব। এরপর ৭৪ রানে মোয়েজেস এনরিকসকে ফেরান শরিফুল। আর সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সফর ব্যাটসম্যান মার্শ ব্যক্তিগত ৫১ ও দলীয় ৯৪ রানে যখন ফিরে যান, তখন অস্ট্রেলিয়া দল কাঁপছে।
এরপর মুস্তাফিজের স্লোয়ার আর বুদ্ধিদীপ্ত কাটারে ব্যাটই লাগাতে পারছিলেন না সফরকারীরা। আর রান আস্কিং রান রেট বেড়ে শেষ ওভারে গিয়ে দাঁড়ায় ২২ রানে। যা করা অসম্ভব প্রায় এই উইকেটে।
বাংলাদেশের স্কোর এগিয়েছে যেভাবে
এর আগে বাংলাদেশের শুরুটাও ভালো হয়নি।
ম্যাচে দলীয় তিন রানেই পরপর সাজঘরে ফেরেন দুই ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম ও সৌম্য সরকার। আর শুরুতেই আঘাতে রানের গতি যায় কমে। ৫ ওভারে রান উঠে ২০।
এমন বিপর্যয়ে ইনিংস মেরামতের দায়িত্ব নেন সাকিব আল হাসান এবং অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। মন্থর গতিতে হলেও সচল রাখেন রানের চাকা।
কিছুক্ষণ রয়ে সয়ে খেলার পর মারমুখী হন সাকিব। বাড়াতে থাকেন রানের গতি। তাকে বেশি দূর এগুতে দেননি অজি স্পিনার অ্যাডাম জ্যাম্পা। তার বলে অ্যাস্টন এইগারের তালুবন্দি হয়ে ১৭ বলে ২৬ করে ফেরেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার।
আগের ম্যাচে জয়ের নায়ক আফিফ হোসেন এই ম্যাচে বেশিদূর এগুতে পারেননি। ১৩ বলে ১৯ করে অ্যালেক্স ক্যারির ডিরেক্ট হিটে রান আউট হন তিনি। তাতে ৭৬ রান তুলতে ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
তিন রান করে জশ হেইজলউডের স্লো বাউন্সারে বড় শট খেলতে গিয়ে বেন ম্যাকডরমটের হাতে ক্যাচ তুলে দেন শামীম হোসেন। সেই রেশ না কাটতেই মাহমুদুল্লাহর ভুলে রান আউন হন নুরুল হাসান সোহান।
উইকেট কামড়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে তুলে নেন টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে পঞ্চম অর্ধশতক।
নিজের অর্ধশতক তুলে নেওয়ার পথে শট খেলছেন মাহমুদুল্লাহ। ছবি: এএফপি
৫৩ বলে চার বাউন্ডারিতে ৫২ রান করা মাহমুদুল্লাহ শিকার হন অস্ট্রেলিয়ার অভিষিক্ত নেইথান এলিসের। শেষ ওভারের চতুর্থ বলে বোল্ড হন তিনি। ততক্ষণে লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। উইকেট হারায় ৯টি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাকিব আল হাসান করেন ২৬ রান। আফিফ হোসেন করেন ১৯ রান।
শেষ ওভারের শেষ তিন বলে তিন উইকেট নিয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন অস্ট্রেলিয়ান পেইসার নেইথান এলিস।
দুই দলের সিরিজের শেষ দুই ম্যাচ ৭ ও ৯ আগস্ট।