ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথী রংপুরে সবার প্রিয় মুখ। মহানগরীর বড় নুরপুর এলাকায় জন্ম নিলেও নিজের কাজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন পুরো রংপুরবাসীর মনে।
করোনভাইরাস মহামারির সঙ্কটে সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায়দের জন্য বিথীর নেয়া পদক্ষেপ আলোচিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চারদিক থেকে প্রশংসায় ভাসছেন এই সাবেক ক্রিকেটার।
১৯৯৮ সালে জন্ম নেয়া বিথী চারভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। পেট্রোল পাম্পের কর্মী বাবা আর মুদি দোকানদার মায়ের সংসারে অভাব লেগেই থাকত। কিন্তু বীথি হাল ছাড়েননি। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি।
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব চাপে তার কাঁধে। নিউজবাংলাকে বিথী জানান তার শুরুর গল্পটা। বলেন, ‘তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে, ইন্টার স্কুল খেলা নিয়ে একটি চিঠি আসে। যেহেতু ভালো খেলতাম, তাই আমাকে টিমের ক্যাপ্টেন বানানো হলো। ওই খেলায় টিমের মধ্যে ভালো করি।’
সেখান থেকে সুযোগ হয় জেলার স্কুল পর্যায়ের দলে। শুরুতে ক্রিকেট নিয়ে ধারণা না থাকলেও ধীরে ধীরে খেলাটির প্রতি আগ্রহবোধ করেন বিথী।
‘ক্রিকেট কী সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। শুরু করি তখন একটা ভালোলাগা, ভালোবাসা জন্ম নেয়। খোঁজ নিতে থাকি রংপুরে কোথাও মেয়েদের খেলা শেখানো হয় কি না। জানতে পারলাম, শুধু রংপুরে না বাংলাদেশের সব জায়গায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিম বলতেও একটি টিম আছে, সেটাও জানতাম না।’
বীথি আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার ও সাবেক অধিনায়ক সালমা খাতুনকে দেখে। রংপুর স্টেডিয়ামে বিকেএসপির একটা ক্রিকেট ট্রায়ালে হাজির ছিলেন সালমা। সেখানেই নিজের ভবিষ্যত আইডলকে দেখেন বিথী।
বলেন, ‘সালমা আপুরা অনেকে চশমা পরে, ভালো ভালো পোশাক পরে অনেক সুন্দর করে সেজে এসেছিলেন। দেখে অনেক ভালো লাগে আমার। তখন ভাবলাম, এটা প্রোফেশন হতে পারে। যদিও সেবার বিকেএসপির ট্রায়ালে টিকিনি।’
সালমাদের দেখে ক্রিকেটের যে পোকা ঢোকে বিথীর মাথায়, সেটার পেছনে লেগে থাকেন তিনি। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে বেছে নেন ক্রিকেট ক্যারিয়ার। ক্রিকেট শেখা শুরু করেন রংপুরেই।
‘রংপুরে পান্থকুঞ্জ নামে একটা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি আছে, সেখানে ভর্তি হই। সামাজিক দিক দিয়ে সমস্যা ছিল। যাতায়াতেও অনেক সমস্যা হতো। রিক্সা ভাড়া করে যাওয়া-আসার টাকা থাকতো না। স্কুলের পর হেঁটে যেতে অনেক সময় লাগত। মাঠে গিয়ে দেখতাম প্র্যাকটিস শেষ। যেদিন রিকশায় যেতাম সেদিন প্রাকটিস করতে পারতাম।'
এরপর ধীরে ধীরে স্থানীয় ক্রিকেট, সেখা থেকে জেলা পর্যায় ও বিভাগীয় পর্যায়ে পৌঁছে যান বিথী। ঢাকার প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসেন ২০১২ সালে। এখানের পেশাদার ক্রিকেটেও অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি।
বলেন, ‘২০১৫ সালে প্রথম ডিভিশনে একটা দলের অধিনায়কত্ব করি। দল দুর্বল হত্তয়ার পরও সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাই আমরা।’
স্বপ্ন যখন স্থানীয়, ডিভিশন, প্রিমিয়ার লিগ ছাড়িয়ে জাতীয় দলে খেলার, তখনই ঘটে ছন্দপতন। শারীরিক সমস্যায় সরে আসতে হয় মাঠ থেকে।
বিথী বলেন, ‘২০১৭ সালে রায়েরবাজারের হয়ে ঢাকায় খেলতে যাই। সব সময় হাঁচি-কাঁশি হতো, গা চুলকাতো। প্র্যাকটিসটা অনেক কঠিন ছিল। প্রাকটিস করতে করতে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। নানা পরীক্ষার পর জানা যায়, নাকের এক পাশে ইনফেকশন হয়েছে। ধুলোবালিতে বেশি থাকি বা খেলার চাপ নেই তাহলে এই রোগ ক্যান্সারের দিকে চলে যেতে পারে।’
অসুখের বিষয়টি পরিবারে জানাজানি হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় তার ক্রিকেট। তবে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও স্থানীয় ক্রিকেটারদের স্বপ্ন পূরণে এখন তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
নিজের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ছাত্রীদের সঙ্গে বিথি। ছবি: নিউজবাংলা
কোচিংয়ের হাতেখড়ি হয় ২০১৯-এ। সুযোগ আসে হুইলচেয়ার ক্রিকেটারদের অনুশীলন করানোর।
বিথী বলেন, ‘এক বড় ভাই আমাকে বলে বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট টিম হবে। মেয়েদের শেখাতে পারব কিনা? তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে কোচিং করাই। সেটা ফেসবুকে দেয়ার পর ফার্স্ট ডিভিশনের এক কোচ তার টিমের কোচিং করানোর জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। সেবারই ফার্স্ট ডিভিশনের কোচিং করাই।’
ডিভিশনে কোচ হিসেবে জায়গা করে নেয়ার পর নিজের অ্যাকাডেম খোলার পরিকল্পনা করেন বিথী। স্থানীয় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে শুরু হয় তার ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট অ্যাকাডেমি।’
বিথী বলেন, ‘টাকা ম্যানেজ হলো, মাঠ হলো, এখন প্রয়োজন মেয়েদের। স্কুলে স্কুলে গিয়ে বিষয়টি জানালাম। পরিবারের সদস্যদের ডাকলাম। তারা সাড়া দিলেন। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর ৩০ জন তরুণ ক্রিকেটার নিয়ে যাত্রা শুরু হয় অ্যাকাডেমির। দুই মাসের মধ্যে ২৫০ জনের বেশি ভর্তি হন। সবাইকে ফ্রি কোচিং করাচ্ছি।’
এতজন ছাত্রকে বিনামূল্যে তালিম দিতে গিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় খাটতে হচ্ছে বিথীকে। নিজের স্কুটি কেনার জন্য জমিয়ে রাখা ৯০ হাজার টাকার পুরোটাই দেন অ্যাকাডেমির পেছনে। কোচিং, অনলাইনে নানাবিধ কাজ এবং বোনের বিউটি পার্লার থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই চলছে তার ক্রিকেট কোচিং।
তার অ্যাকাডেমি থেকে এরই মধ্যে ৮ জন সুযোগ পেয়েছে বিকেএসপিতে। বিথীর স্বপ্ন জাতীয় দলে থাকবে তার অ্যাকাডেমির অন্তত পাঁচ খেলোয়াড়।
করোনাভাইরাস মহামারি ও মাঠের বাইরে অন্যরকম পদক্ষেপ
করোনাভাইরাস মহামারিতে পুরো বিশ্বের মতো রংপুরেও স্থবির হয়ে পড়ে ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাধুলার কার্যক্রম। তবে এই সময়টাতে বসে থাকতে চাননি বিথী। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন করোনায় সংগ্রাম করতে থাকা আশেপাশের মানুষের দিকে।
যোগাযোগের উপায় হিসেবে বেছে নেন ফেসবুক। বিথীর নিজের কথাতে, ‘ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেই, আমার পরিচিত বা কেউ যদি ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছেন বা ক্ষুধার্ত হন তাহলে যেন আমাকে জানান। এমন এমন মানুষ আমাকে ফোন দিয়েছেন, তাদের কখনও অভাব ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু তারা এই খারাপ পরিস্থিতিতে ফোন দিয়েছে। তখন তাদের একটা তালিকা করি ও তাদের কাউকে ৭ দিন বা কাউকে ১৫ দিনের বাজার করে দিয়ে আসি।’
করোনা মহামারিতে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করছেন বিথী। ছবি: নিউজবাংলা
এছাড়াও গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ এক উদ্যোগ নিয়েছেন বিথী। এ ক্ষেত্রেও তিনি সাহায্য নেন ফেসবুকের।
বিথী বলেন, ‘ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেই, এক ফোনে চলে যাবে গভবর্তী মাদের ঘরে খাবার। এটা দেখার পর অসংখ্য গভবর্তী মা ফোন দিয়েছেন। শুধু রংপুর থেকে নয় সিলেট, কক্সবাজার, চট্রগ্রাম বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসে। প্রথমে রংপুর জেলা থেকে শুরু করি।’
গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিথীর খাদ্য সহয়তা। ছবি: নিউজবাংলা
এই উদ্যোগে অভূতপূর্ব সাড়া পান বিথী। জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড়রা এগিয়ে আসেন। সাহায্য করেন বিথীকে।
নিউজবাংলাকে বিথী বলেন, ‘জাতীয় দলের তামিম ইকবাল ও রুবেল হোসেন ভাই আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। এভাবেই সকলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। এখন পর্যন্ত ১৫ জন মা-বাবাকে ঘরবাড়ি করে দেয়া হয়েছে, ৫০ জনের বেশি নারীদের সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হয়েছে। অনেককে মুদিখানা করে দেয়া হয়েছে।’
‘করোনার এই সময়ে অনেকের সামর্থ্য ছিল না। অনেকের সাহায্য নিয়ে ৭০০-রও বেশি পরিবারকে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়েছে।’