তারিখটা নয় ফেব্রুয়ারি, ২০২০। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে সাউথ আফ্রিকার পচেফসট্রুমে শিরোপা লড়াইয়ে বাংলাদেশ বনাম ভারত।
পুরো টুর্নামেন্টে ভারতের ব্যাটিং স্তম্ভ হয়ে থাকা ইয়াসসভি জসওয়ালকে ফেরালেন বাংলাদেশের বাঁহাতি পেইসার শরিফুল ইসলাম। ফিরিয়েই করলেন ভিন্ন এক উদযাপন।
প্রথমে ট্রাউজারের ডান পকেটের জিপারটা আটকে দিলেন। এরপর সেটাকে কিছুক্ষণ হাতে ঝেড়ে তর্জনীটা মুখের সামনে নিয়ে আসলেন, যার সার্বজনীন অর্থ, ‘চুপ করো!’
এমন উদযাপন কেনো? প্রশ্নই করা হয়েছিল শরিফুলকে। নিউজবাংলাকে শরিফুল বললেন, ঢাকায় ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনাল জেতার পর ভারতীয় দল তাদের ড্রেসিং রুমের সামনে এসে করেছিল নানা উদযাপন। সেটির বদলা নেওয়ার জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালের চেয়ে ভালো মঞ্চ আর কী হতে পারে!
‘এশিয়া কাপের ফাইনালে জেতার পর আমাদের ড্রেসিং রুমের সামনে এসে খুব খুব বাজে বাজে সেলেব্রেশন করেছিল। আমরা সেটা নিতে পারিনি। আমার খুব আঁতে ঘা লেগেছিল বিশেষ করে। ভাবছিলাম, যে আমরা সুযোগ পেলে সেটার প্রতিশোধ নেব।’
হাসতে হাসতে পুরো পরিকল্পনার বিস্তারিত জানান এই তরুণ পেইসার।
“বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে টিম মিটিং হওয়ার পরে আমার রুমমেট সাকিবকে বললাম, ‘ওরা তো আমাদের ছাড়বে না, স্লেজিং করবে, অনেক কিছু করবে। আমরা যখনই বোলিং পাই, তখনই আক্রমণাত্মক থাকতে হবে আর সেলেব্রেশন করতে হবে একটা স্পেশাল।’ তো ও খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন আমি বলেছিলাম আমি এটা করব। এরপর গেলাম ফাইনাল খেলতে, উইকেট পাওয়ার পর উদযাপনও করলাম। তোমাদের দিন শেষ। তোমরা এখন পকেটের ভেতরে ঢুকে যাও- এইটাই মানে ছিল।”
উদযাপনটা শেষ পর্যন্ত আর উইকেটে আটকে থাকেনি সেদিন। প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের কোনো বৈশ্বিক শিরোপা এসেছিল বাংলাদেশে। শরিফুলদের হাত ধরেই। এতটা আনন্দিত ও উত্তেজিত ছিলেন তারা, ফাইনালের পর নাকি তিন-চার দিন ঘুমাতে পারেননি।
‘বিশ্বকাপ ফাইনালের পর প্রথম ৩-৪ দিন কোনো ঘুমই হয়নি। দিনেও না। রাতেও না। সব সময় চোখের সামনে ভাসছিল যে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একটা সফলতা অর্জন করেছি। পুরো বাংলাদেশের জন্য এত বড় একটা দিন, সেটার নায়ক আমরা। যখন দেশে ফিরেছি, এয়ারপোর্ট থেকেই পুরো রাস্তা সবাই আমাদের সাপোর্ট করছিল। ওটা দেখার পর মনে হয়েছে বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। খুবই এক্সাইটেড ছিলাম। বলে বুঝানো যাবে না।’
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শরিফুলের সেই উদযাপন। ছবি: আইসিসি
নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপে শরিফুল শোনান বিশ্বজয়ের আগের গল্প। পঞ্চগড়ে ছেলেবেলা কেটেছে তার। অভাবের সংসারে বড় হয়েছেন। স্বপ্ন ছিল পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন করবেন ক্রিকেট দিয়েই। যে বাঁ হাতের ফাস্ট বোলিংয়ে এসেছেন এত দূর, সেটির কীভাবে শুরু, সেট তার নিজেরই মনে নেই!
‘শুরু থেকেই পেস বোলিং করতাম। যখন ছোট ছিলাম এমনি এমনি হাত ঘুরাতাম। বুঝতাম না কোনটা পেইস, কোনটা স্পিন। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে ওরকম হয়ে গিয়েছে।’
জাতীয় পর্যায়ের পেইসার হওয়ার যাত্রাটা কোনোভাবেই সহজ ছিল না শরিফুলের। কৃষক বাবার সন্তান জানান ঠিকমতো খাবারও জুটতো না তাদের। সেখান থেকেই নিজের লক্ষ্য ঠিক করেন তিনি। ক্রিকেট দিয়েই পরিবর্তন করবেন পরিস্থিতির।
‘আমাদের পরিবারের এমন অবস্থা ছিল যে খাবারও ঠিকমত জুটত না। যখন প্র্যাকটিস করতাম, তখন চিন্তা করতাম যে একদিন আমিই পরিবারের অবস্থায় পরিবর্তন আনব। এই লক্ষ্য ছিল যে পরিবারকে সুখে রাখব। জাতীয় দলে খেলব। অনেক পরিশ্রম করেছি। যে স্বপ্নটা আমার ছিল সেটা ধরে রেখেছি।’
ক্রিকেটকেই শরিফুল জীবনের লক্ষ্য বানাবেন, সেটিতে শুরুতে সায় ছিল না পরিবারের। শরিফুল বলেন, ‘আমার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার যাত্রাটা খুবই কঠিন ছিল। পরিবার শুরুতে একদমই সমর্থন করেনি। যখন ক্লেমন পেইস অ্যাকাডেমিতে নিয়ে গেলেন আমার কোচ (আলমগীর কবির), তখন একটু সমর্থন দেয়।’
প্রথম বার যখন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেন শরিফুল প্রাইম ব্যাংকের হয়ে। চুক্তির টাকা পেলেন চেকের মাধ্যমে। কিন্তু টাকা তুলবেন কীভাবে? তার যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টই নেই!
‘২০১৭ সালে যখন আমি প্রথম বার আমি প্রাইম ব্যাংকে খেলি, ওরা আমাকে আমাকে চেক দিয়েছিল। আমার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টই ছিল না। টাকা উঠাতে পারছিলাম না। পরে এক পরিচিত কর্মকর্তার সহায়তায় একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে তারপর কোনোমতে উঠাতে পারি।’
শরিফুলের অধ্যাবসায়ের ফল মিলেছে। এরই মধ্যে গায়ে চাপিয়েছেন জাতীয় দলের জার্সি। তবে এখনও বাকি ওয়ানডে অভিষেক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেই ওয়ানডে দলে জায়গা পাওয়ার প্রত্যাশা তার।
আছেন প্রাথমিক দলেও। ওয়ানডে অভিষেক হলে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দেড় বছরের ভেতরই তিন ফরম্যাট খেলে ফেলবেন শরিফুল।
জাতীয় পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন সফল হয়েছে তার তবে এখনও বাকি অনেক পথ। সেটি জানেন শরিফুল নিজেও। তার স্বপ্নটা এখন জাতীয় জার্সিতে বহুদূর যাওয়ার।