বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম উইকেটকিপার কে, এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গবেষণা করতে হবে না। তিনি মুশফিকুর রহিমই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেটকিপার হিসেবে ৩৮৮ ইনিংস খেলেছেন মুশফিক, তাতে তার মোট ডিসমিসাল ৪০৬টি। এর মধ্যে ৩১৬টি ক্যাচ ও ৯০টি স্ট্যাম্পিং। ওয়ানডেতে ২৩৪টি ডিসমিসাল রয়েছে তার, এতে ১৮৮টি ক্যাচ ও ৪৬ স্ট্যাম্পিং। টেস্টে ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং যথাক্রমে ১০৬ ও ১৫টি, টি-টোয়েন্টিতে ৬২ ও ৩৩টি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডিসমিসাল খালেদ মাসুদের, কিন্তু ২১৩টি ডিসমিসাল নিয়ে তিনি মুশফিক থেকে পিছিয়ে আছেন বিরাট ব্যবধানে।
তাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম উইকেটকিপার কে, এই প্রশ্ন নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন আসে, মুশফিক কী আদৌ বাংলাদেশ দলের সেরা উইকেটকিপার?
সেরা এবং সফলতম- এই দুটির মধ্যে পার্থক্যের প্রশ্নটা এ কারণেই যে, কেউ সফল হলেই তিনি সেরা হবেন এমনটি নয়। উইকেটকিপিংয়ের সঙ্গে ব্যাটিং মিলিয়ে যে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, তাতে মুশফিক সফলতম এবং সেরাও। কিন্তু স্রেফ উইকেটকিপিংয়ের কৌশলের বিচারে মুশফিকই সেরা কি না, তা নিয়ে নানা সময়ে উঠেছে প্রশ্ন।
নানা সময়ের এই প্রশ্নগুলো সামনে আসার কারণ মুশফিক নিজেই। মুশফিক সহজ সুযোগ নিতে গিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন, এমন দৃশ্য নিয়মিতই আসছে বাংলাদেশ সমর্থকদের সামনে।
২০১৬ সাল পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায়, টেস্টে মুশফিকুর রহিম তার পাওয়া সুযোগগুলোর মধ্যে মিস করেছেন ৩২ শতাংশ! তার সমসাময়িক উইকেটকিপারদের মধ্যে পাকিস্তানের সরফরাজ আহমেদ মিস করেছেন ২১ শতাংশ, বিজে ওয়াটলিং মাত্র ১১ শতাংশ।
২০১৬-এর পরও বেশ কিছু সাধারণ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন মুশফিক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টেস্টে উইকেটকিপিং ছাড়েন ২০১৯ সালে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট হারের পর। তার পর দায়িত্ব নেন লিটন দাস।
সেই লিটন আছেন ওয়ানডে দলেও, নিয়মিত মুখ হিসেবেই। কিন্তু লিটন সুযোগ পাচ্ছেন না উইকেটকিপার হিসেবে। কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, মুশফিকের তুলনায় লিটন ভালো ফিল্ডার হওয়ায়ই এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু কিপিংয়ে কি এগিয়ে মুশফিক?
এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তি উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ বলেন, মুশফিক ভালো কিপার হলেও সেরার বিচারে আসবেন না। সে জায়গা নুরুল হাসান সোহান এবং লিটনের জন্যই বরাদ্দ।
‘মুশফিক ভালো কিপার। কিন্তু সে বাংলাদেশের সেরা না। সেরা কিপার বললে বলব সোহান এবং লিটন’, বলেন তিনি।
মুশফিক ভুল করছেন নিয়মিতই। ২০১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তামিম ইকবালের থ্রো থেকে তাদের অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনকে আউট করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল, কিন্তু আগেই হাত দিয়ে স্ট্যাম্প ভেঙে দিয়ে তা নষ্ট করেন মুশফিক। সেই সুযোগ পেয়ে রস টেইলরকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ভিত গড়ে দেন উইলিয়ামসন। অথচ সেই ম্যাচ জিততে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ শুরু করতো টানা দুই জয় দিয়ে!
বিশ্বকাপে উইলিয়ামসনকে আউট করার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন মুশফিক। ছবি: সংগৃহীত
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে শুক্রবার শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজেও একের পর এক ভুল করেছেন মুশফিক। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭২ করা ডেভন কনওয়ের বিদায়ের পর সুযোগ ছিল চাপ বাড়ানোর। সুযোগ তৈরিও করেছিলেন তাসকিন আহমেদ, জিমি নিশামকে বাধ্য করেছিলেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে। কিন্তু সেই ক্যাচ ফেলে দেন মুশফিক। নিশামের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টম ল্যাথাম।
তৃতীয় ম্যাচে ভুলের সংখ্যা একাধিক। পাওয়ারপ্লেতেই তাসকিনের বলে হেনরি নিকোলসের ক্যাচ ছাড়লেন, যে ক্যাচ ধরার চেয়ে হয়তো ছাড়াটাই কঠিন। বল দুয়েকের মধ্যে অবশ্য তাসকিনের বলেই গালিতে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন নিকোলস। ক্যাচ নিলেন কে? লিটন!
নিউজিল্যান্ড ইনিংসের শেষ বলে ড্যারেল মিচেল দুই রান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু যখন বাউন্ডারি থেকে বল চলে এসেছে মুশফিকের কাছে, মিচেল ক্রিজ থেকে অনেক দূরে। দুই হাতের বদলে এক হাত দিয়ে বল ধরতে গেলেন মুশফিক, তাতে বল ধরতে পারলেন না। মিচেলও তাতে দুই রান নিয়ে তুলে নেন নিজের সেঞ্চুরি।
মুশফিকের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতিকেই এমন ভুলের কারণ হিসেবে দেখছেন খালেদ মাসুদ। তিনি বলেন, মুশফিকের শরীর নড়ছে না ঠিকভাবে।
‘সাম্প্রতিক সময়ে হয়ত তার আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি আছে। তার এই সময়টা ভালো যাচ্ছে না। ওর কিপিংয়ে সমস্যা হচ্ছে, ওর শরীর বলের লাইনে যাচ্ছে না। সে নিজের জায়গা থেকেই ডাইভ দিচ্ছে। ফার্স্ট স্লিপের কাছে যে বলটা যাচ্ছে, সে নিজের জায়গা থেকে ডাইভ দিচ্ছে। ডাইভ দিয়ে হয়তো মাঝেমধ্যে ধরে ফেলবে, কিন্তু তার চেয়েও ভালো হয় যদি এক পা সরে এসে বলের লাইনে যাওয়া যায়। তাহলে বলটা খুব কাছে পাওয়া যায়, ক্যাচ ধরাটা সহজ হয়ে যায়। আমার যা মনে হয়, যখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়, তখন এ রকম হতে থাকে, শরীর নড়ে না’, বলেন বাংলাদেশের দলের সাবেক উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ।
এর সমাধান হিসেবে তিনি দেখছেন লিটনকে কিপিং এবং মুশফিককে একটু স্বস্তি দেয়া।
খালেদ মাসুদ বলেন, ‘লিটনকে কিপিংয়ে দিয়ে মুশফিককে ফিল্ডিংয়ে একটু রিল্যাক্স করানো উচিত। কারণ কিপিং এমন একটা ব্যাপার, এই যে মানসিকভাবে একটু পর্যুদস্ত হয়েছেন, তা থেকে ফিরতে বেশ সময় লাগে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ও ভালো ক্যাচ বা স্ট্যাম্পিং করবে, ওর এখান থেকে ফেরাটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। তার সময় লাগবে। এখন তার কিপিংয়ের আশায় কী বসে থাকবে দল? সেটা অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, শেষ পর্যন্ত বিষয়টি অধিনায়ক ও ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ‘এটা (কে কিপিং করবে) কোচ এবং অধিনায়কের মত। অধিনায়ককে তার দলের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দলের পারফরম্যান্সের জন্য কোন খেলোয়াড়ের কাছে থেকে কী ধরনের পারফরম্যান্স আশা করছেন তিনি।’
আপাতত নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে সিরিজ শেষ করে বাংলাদেশের অপেক্ষা টি-টোয়েন্টি সিরিজের। সেখানেও কিপার হিসেবে দেখা যাওয়ার কথা মুশফিককেই। টেস্টে উইকেটকিপিং ছাড়লেও রঙিন পোশাকে এখনও গ্লাভসজোড়া তার হাতেই। ৩৩ বছর বয়সী মুশফিক আর মিস করবেন না, এমনটিই প্রত্যাশা রাখবেন সমর্থকরা!