১৫ বছর আগের ঠিক এই দিন। ১২ মার্চ, ২০০৬। সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ।
এমন এক সময়ের কথা, যখন অস্ট্রেলিয়া রীতিমত অপরাজেয়। আগের দুই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, রিকি পন্টিংয়ের দল আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বসেরা।
সাউথ আফ্রিকার মাটিতে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর অস্ট্রেলিয়া তাই কড়া জবাব দেবে, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। পরের দুই ম্যাচ জিতে সিরিজে ফেরে তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
জোহানেসবার্গে যে ম্যাচের কথা হচ্ছে, সেই ম্যাচ তাই দাঁড়িয়ে যায় সিরিজ নির্ধারণী হিসেবে। টস করতে নামেন গ্রায়েম স্মিথ ও পন্টিং। ভাগ্য হাসে পন্টিংয়ের দিকেই।
ক্রিকেটের আদি পিতা বলা হয় ডব্লিউ জি গ্রেসকে। তার অসংখ্য অমর বাণীর একটি হচ্ছে, ‘টসে জিতলে ব্যাটিং নাও। সন্দেহে থাকলে চিন্তা করে তারপর ব্যাটিং নাও।’
পন্টিং সেটিই শুনলেন। ব্যাটিংয়ে নেমে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তাণ্ডব। মাত্র ৩৫ বলে ফিফটি। যতক্ষণে ডানহাতি পেইসার রজার টেলেমাকাসের বলে ফিরলেন, সাইমন ক্যাটিচের সঙ্গে তার ওপেনিং জুটি ৯২ বলে তুলেছে ৯৭।
আসল ঝড় কাকে বলে, দেখালেন পন্টিং ও মাইক হাসি মিলে। অজি অধিনায়ক প্রথমে ক্যাটিচের সঙ্গে গড়েন ৯১ বলে ১১৯ রানের জুটি। তাতে পন্টিংয়ের ফিফটি ৪৩ বলে। ক্যাটিচ ছিলেন ধীরস্থির। মাখায়া এনটিনির বলে ফেরার আগে করলেন ৯০ বলে ৭৯।
সাউথ আফ্রিকান বোলারদের ওপর ঝড় বইল তৃতীয় উইকেটে পন্টিং-হাসি জুটিতে। জুটিটি টিকেছিল মাত্র ৯৪ বল। তাতে রান এলো ১৫৮। পন্টিং সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন ৭১ বলে। ১০৫ নম্বর বলে যখন ফিরলেন তার রান ১৬৪!
মাত্র ১০৫ বলে ১৬৪ রান করেন রিকি পন্টিং। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রলিয়া
অন্যদিকে হাসিও কম যান না। ৩৩ বলে ফিফটি করেছেন, শেষ পর্যন্ত যখন আউট হন, ৫১ বলে করে ফেলেছেন ৮১। শেষ দিকে এন্ড্রু সাইমন্ডসের ১৩ বলে ২৭ এ অস্ট্রেলিয়া তাদের ইনিংস শেষ করে ৪৩৪ রানে। যা কিনা ওয়ানডে ক্রিকেটের তখনকার সর্বোচ্চ স্কোর ও প্রথম চার শ ছাড়ান ইনিংস।
ড্রেসিং রুমে গিয়ে সাউথ আফ্রিকানদের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, এত রান হবে কীভাবে। এর আগে যে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪০০ রানই হয়নি!
ফাস্ট বোলারদের জন্য পয়মন্ত ওয়ান্ডারার্সের বুল রিং হঠাৎই যেন সেদিন ব্যাটসম্যানদের স্বর্গরাজ্য। সেটা বুঝেই কিংব্দন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস ইনিংস বিরতিতে দলকে বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা ভালো করেছি। মনে হচ্ছে ওরা ১৫ রান কম করেছে।’
ক্যালিসের এক লাইনেই ড্রেসিং রুমের শঙ্কা মিলিয়ে যায় বাতাসে। সেই শঙ্কা ফিরে আসে দ্বিতীয় ওভারেই সাউথ আফ্রিকান ওপেনার বোয়েটা ডিপেনার বিদায় নিলে।
দ্রুত উইকেট পেয়ে আনন্দিতই ছিল অস্ট্রেলিয়া। তারা জানতো না, ঝামেলা ডেকে নিয়ে এসেছে তারা। তিন নম্বরে যে ব্যাটিংয়ে নামেন হার্শেল গিবস!
ব্যাট নয়, যেন খাপখোলা তরবারি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন গিবস। সঙ্গে অধিনায়ক স্মিথও তার যোগ্য সঙ্গী। শুরুতে গিবস একটু শান্তই ছিলেন। ফিফটি তুলে নেন ৪৬ বলে। স্মিথ মাত্র ৩৩ বলে!
দুজনের জুটি যখন ভেঙেছে, ততক্ষণে দুজনে মিলে স্কোরবোর্ডে ১২৫ বলে ১৮৭। ৯০ এর ঘরে যেতে স্মিথ সময় নেন ৫৪ বল। ৫৫তম বলে সেই ৯০ রানেই ফেরেন মাইকেল ক্লার্কের বলে।
এরপর গিবস-শো। ৫০ থেকে তিন অঙ্কের ঘরে যেতে সময় নিলেন ৩৩ বল। ১০০ থেকে ১৫০ এ যেতে মাত্র ২১ বল। শেষ ১১ বলে আরও ২৫। শেষ পর্যন্ত যখন সাইমন্ডসের বলে ফিরেছেন, ১১১ বলে করেছেন ১৭৫। ৩২ ওভার পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রোটিয়াদের রান ২৯৯!
মাত্র ১১১ বলে ১৭৫ করেন গিবস। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
এবি ডি ভিলিয়ার্স, ক্যালিস কিংবা জাস্টিন কেম্প- কেউই খুব বেশিক্ষণ থাকেননি ক্রিজে। ছিলেন মার্ক বাউচার। তাকে সঙ্গে দিলেন অলরাউন্ডার ইয়োহান ভ্যান ডার ভাথ। ভাথ করলেন মাত্র ১৮ বলে ৩৫। বাউচারের সঙ্গে তার ৪৪ রানের জুটিটা স্বাগতিকদের নিয়ে যায় ৩৯৯ রানে। সেখান থেকে টেলেমাকাস ছয় বলে ১২ করে যখন ফেরেন, সাউথ আফ্রিকার হাতে অক্ষত দুই উইকেট। তখনও চাই দশ বলে ১২ রান।
ওভারের বাকি চার বলে আসে পাঁচ রান। শেষ ওভারে চাওয়া সাত। স্ট্রাইকে মার্ক বাউচার। ব্রেট লির প্রথম বলে বাউচার সিঙ্গেল নিতে পারলেন কেবল, স্ট্রাইক প্রান্তে প্রথম বলেই চার হাঁকান এন্ড্রু হল।
কিন্তু আরেকবার মোড় নিল এই অদ্ভুত ম্যাচের চরিত্র, ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন হল। স্ট্রাইকে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান এনটিনি, সাউথ আফ্রিকার জয়ের জন্য তখনও চাই দুই রান।
এনটিনি সিঙ্গেল নিলেন, তাতে অন্তত হার এড়ায় সাউথ আফ্রিকা। আর পরের বলে?
এক রান বাঁচাতে সব ফিল্ডারকে সামনে নিয়ে এলেন পন্টিং। সেই সুযোগটা পুরো লুফে নিলেন বাউচার। লির গুড লেংথের বলটা মিড অনের মাথার ওপর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারিতে। বিশ্বরেকর্ড তাড়া তো বটেই, ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও নিজেদের করে নেয় তারা।
সেই ম্যাচের ঠিক ঠিক ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর সাউথ আফ্রিকার থেকে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা শ্রীলঙ্কা ঘুরে এখন ইংল্যান্ডের কাছে।
সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ডে এখনও ভাগ বসাতে পারেনি কেউ। ওয়ান্ডারার্সে গড়া সাউথ আফ্রিকার সেই রেকর্ড এখনও টিকে আছে, হয়ত থাকবে আরও অনেক দিন।