বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবদানের কথা জানা আছে সবারই। জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, আলী ইমাম, অমলেশ সেন, কাজী সালাউদ্দিনরা মিলে ফুটবলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে তুলেছিলেন জনমত, করেছিলেন তহবিল সংগ্রহ।
কিন্তু অনেকেরই জানা নেই সে সময়ে তৈরি করার কথা ছিল স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলও। সে দলের অধিনায়ক হওয়ার কথা ছিল রকিবুল হাসানের। দলের পরিকল্পনায় ছিলেন শামীম কবিরের মতো ক্রিকেটাররা।
সেই রকিবুল, যিনি পাকিস্তানি শোষণের প্রতিবাদে ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার নিয়ে নেমে পড়েছিলেন মাঠে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সংগঠক সাইদুর রহমান প্যাটেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্ল্যান ছিল ফুটবল, হকি, ক্রিকেট সব হবে।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ হাজরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আলোচনায় উঠে এসেছিল স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল তৈরির বিষয়টি। তবে সেটি আলোচনার পর্যায়েই ছিল, পরিকল্পনা হয়ে ওঠেনি।’
রকিবুল নিউজবাংলাকে জানান পুরো গল্পই। কীভাবে শুরু হয়েছিল সে দলের পরিকল্পনা, ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে মাঠে নামার পরের গল্প।
“সেদিন ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি, ম্যাচের চতুর্থ দিন। আমি ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে নামলাম। এই খবরটা দেশ-বিদেশে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আমাকে দেশদ্রোহী বানিয়ে ফেলে। আমাকে হত্যা করতে চাইছিল তারা।”
‘এরপর পালালাম ঢাকা থেকে। আমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। সেখানে আমবাগানে ট্রেনিং চলছিল। সেখানে যোগ দেই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি শুরু করি। লুকিয়ে থাকতে হতো। কারণ আমাদের কাপড়চোপড়, চেহারা গ্রামবাসীর সাথে মিলত না’, যোগ করেন রকিবুল।
স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলের চিন্তা রকিবুলকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ শহীদুল ইসলাম। তিনি রকিবুলকে বলেন, সেই দলে অধিনায়কত্ব করার।
“উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই স্বাধীন বাংলা বেতার শুনিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যা, শুনি।’ বললেন, ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যে খেলে বেড়াচ্ছে এটা জানিস?’ বললাম, ‘হ্যা, জানি।’ উনি বললেন যে স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল হবে। ‘কার নেতৃত্বে হবে?’ এই প্রশ্নের জবাবে শহিদুল বললেন, ‘তোর নেতৃত্বে হবে’”, বলেন রকিবুল।
সে সময়ে রকিবুল ছিলেন পাকিস্তান দলের হয়ে খেলা একমাত্র বাঙালি। গোপালগঞ্জ থেকে এরপর সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতা চলে যান তিনি। গিয়ে দেখেন, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা থাকছেন ধর্মতলায়।
রকিবুল সেই ফুটবলারদের সঙ্গে না থাকলেও ভারতে বসেই তিনি ছক কষে ফেলেন স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলের। কিন্তু সেই দল কখনও খেলতে নামতে পারেনি।
খেলবেন কীভাবে, তার আগেই যে স্বাধীন হয়ে যায় দেশ! শীতকালের খেলা ক্রিকেট শুরু হওয়ার আগেই তাই শেষ হয়ে যায় সেই দলের গল্প।
‘ভারতে বসেই স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলটা তৈরি করতে শুরু করে দিলাম। ক্রিকেট তো শীতকালে হয়। কিন্তু ডিসেম্বরে তো আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। তার আগেই আমাদের টিম মোটামুটি তৈরি হয়ে যায়।
‘ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পতাকা নিয়ে খেলে বেড়াব এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, সেটা ভারতের জনগণের কাছে আমরা তুলে ধরব আর তহবিল সংগ্রহ। সেটার আর প্রয়োজন হয়নি।’
সাইদুর রহমান প্যাটেল জানান, তারা ভাবেননি, এত তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘ধারণা ছিল, ৪-৫ বছর যুদ্ধ হবে। এত শর্ট টাইমে যুদ্ধ শেষ হবে ধারণা ছিল না।’
স্বপ্নের স্বাধীনতা হাতে পাওয়ায় আর খেলা হয়নি স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলের। তাদের গল্প থেকে গিয়েছিল অসমাপ্ত।