২০০৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ও গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন সাকিব আল হাসান। অসংখ্য স্মরণীয় পারফর্মেন্সের উজ্জ্বল তার এই দীর্ঘ ক্রিকেট যাত্রা। ‘ফিরছেন সাকিব’ সিরিজের শুরুতে থাকছে তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচ কীর্তি।
সাকিবের ‘বাংলাওয়াশ’
২০১০ সালে বাংলাদেশে নিউ জিল্যান্ড এসেছিল ওয়ানডে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন নিয়েই। সেই স্বপ্ন ব্ল্যাকক্যাপদের জন্য পালটে যায় রীতিমতো দুঃস্বপ্নে।
সিরিজে সাকিব ব্যাটিং ও বোলিং-দুইয়েই ছিলেন সেরা। ব্যাট হাতে ৭১ গড়ে ২১৩ রান। সঙ্গে ১৫.৯ গড়ে ১১ উইকেট। সিরিজের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার হয়েছিলেন সাকিব।
প্রথম ম্যাচে ছিলেন না তামিম ইকবাল। বোলিংয়ের সময় প্রথম ওভারে ইনজুরিতে পড়েন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। অধিনায়কত্বের বাড়তি চাপ চলে আসে সহ-অধিনায়ক সাকিবের কাঁধে। সেই চাপই যেন বের করে আনে সাকিবের সেরাটা। ব্যাট হাতে ফিফটির পাশাপাশি বোলিংয়ে চার উইকেট নিয়ে একাই বধ করেন সফরকারীদের।
বৃষ্টিতে ভেসে যায় দ্বিতীয় ম্যাচ। তিন নম্বর ম্যাচে দুই উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৭ বলে ১৩ রানে অপরাজিত থেকে জয় নিয়ে ফেরেন সাকিব।
সিরিজ নির্ধারণী চতুর্থ ম্যাচে ছিল সাকিব শো। ব্যাট হাতে করেন সেঞ্চুরি। বল হাতে তিন উইকেট। তাতেই ম্লান কেন উইলিয়ামসনের শতক। সিরিজ জয় নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের ১৭৪-এ সাকিবের অবদান ৩৬। বল হাতে নেন দুই উইকেট। সেই ম্যাচ জিতেই নিশ্চিত হয় বাংলাওয়াশ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪-০তে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ।
আক্ষেপের এশিয়া কাপ, সাকিবের এশিয়া কাপ
২০১২ সালের এশিয়া কাপ বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক চিরকালীন আফসোস। ফাইনালের দুই রানের আক্ষেপ অনেক দিন পুড়িয়েছে বাংলাদেশকে। সাকিবের আর মুশফিকের কান্নার ছবি ছিল লাখো ভক্তের হৃদয় ভাঙার প্রতিচ্ছবি।
শেষটা হৃদয়বিদারক হলেও পুরো টুর্নামেন্টই ছিল সাকিবময়। চার ম্যাচে করেছিলেন তিন ফিফটি। ভারতের বিপক্ষে করেন ৪৯। দুইবার পেয়েছেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন। সঙ্গীর অভাবে দলকে জেতাতে পারেননি। বাকি দুই ম্যাচে তেমনটি হয়নি। সাকিবের গড়ে দেওয়া ভিতে ভর করে জয় পায় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো পৌঁছায় এশিয়া কাপ ফাইনালে।
ফাইনালেও ফিফটি করেন সাকিব। তা যথেষ্ট ছিল না বাংলাদেশকে শিরোপা জেতাতে। তারপরও তিন ফিফটিতে ২৩৭ রান ও ছয় উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন সাকিব।
রাজসিক প্রত্যাবর্তন
শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ২০১৪ সালে সাকিব নিষিদ্ধ হন ছয় মাসের জন্য। পরে নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনা হয় তিন মাসে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে ফেরেন আহত বাঘের মতো।
প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংস সাকিব পকেটে পুরেন ছয় উইকেট। দ্বিতীয় টেস্টে যা করেন, তা সাকিবকে নিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। এক টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেটে বিরল রেকর্ড গড়েন এই সব্যসাচী। টেস্টের ১৪৩ বছরের ইতিহাসে যা ঘটে তার আগে মাত্র দুই বার।
খুলনায় দ্বিতীয় টেস্টে সাকিবের ১৩৭ ও তামিমের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ রান তোলে ৪৩৩। বল হাতে সাকিব তুলে নেন পাঁচ উইকেট।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও বল হাতে তা হননি সাকিব। তুলে নেন ইনিংসে পাঁচ ও ম্যাচে ১০ উইকেট। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরেন রাজার মতোই। হয়ে যান ইয়ান বোথাম ও ইমরানের খানের পর এক টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেয়া তৃতীয় ক্রিকেটার।
অস্ট্রেলিয়া বধ
আগের বছরই দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে হারায় বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে যখন বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া, সিরিজ জয়ের বাড়তি চাপ ছিল স্বাগতিকদের ওপর।
প্রথম টেস্টের আগের দিন অজি স্কিপার স্টিভেন স্মিথের গলায় ছিল অন্য সুর। অনেকটা হেয় করেই যেন বললেন, ‘বাংলাদেশ আগের ১০০ টেস্টে জিতেছে মাত্র নয়টি। এখনও অনেক দূরের পথ।’
ম্যাচের শুরুটা দেখে মনে হলো স্মিথ ভুল বলেননি। প্যাট কামিন্সের বোলিং তোপে তিন উইকেট নেই ১০ রানের মাথায়। সেখান থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেন সাকিব ও তামিম। দুই জনের ১৫৫ রানের জুটিতে ব্যাটিং বিপর্যয় এড়ায় টাইগাররা। সাকিব আউট হন ৮৪ রানে। ২৬০ রানে শেষ করে বাংলাদেশ।
শের-ই-বাংলার টার্নিং ট্র্যাকে বল হাতে সাকিব হয়ে ওঠেন দানবীয়। বাংলাদেশকে ৪৩ রানের লিড দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সাকিব মুড়িয়ে দেন ২১৭ রানে, ৬৮ রানে তুলে নেন পাঁচ উইকেট।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস শেষে অস্ট্রেলিয়ার সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২৬৫ রানের। তাড়া করতে নেমে ডেভিড ওয়ার্নার ও অধিনায়ক স্মিথের ব্যাটে সহজ জয়ের পথেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। আবারও সেই আশায় পানি ঢেলে দেন সাকিব।
সেঞ্চুরি তুলে নেয়া ওয়ার্নারকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন। মুশফিকের ক্যাচ বানিয়ে আউট করেন স্মিথকে। একে একে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও ম্যাথু ওয়েডকেও পথ দেখান প্যাভিলিয়নের। ১০ উইকেট তুলে নেন সাকিব। দল পায় অবিস্মরণীয় এক জয়।
ম্যাচসেরা কে হবেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন ছিল না কোনো। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয়ে সাকিব নায়ক হবেন এমনটা তো হবারই কথা!
দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপে স্বপ্নের সাকিব
সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন বুকে চেপে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে যায় বাংলাদেশ। সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে দারুণ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত সেই আশা পরিণত হয় হতাশায়। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ শেষ করে নয় দলের মধ্যে অষ্টম স্থানে থেকে।
দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপে স্বপ্নময় হয়ে ছিলেন সাকিব। ছুঁয়েছেন একের পর এক রেকর্ডের চূড়া। যখনই মাঠে নেমেছেন সাকিব গড়েছেন কোনো না কোনো রেকর্ড। শেষ পর্যন্ত ছিলেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে। দলের ব্যর্থতায় সেই অর্জন আর হয়নি সাকিবের।
সাকিব বিশ্বকাপ শেষ করেন ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট নিয়ে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এক আসরে পাঁচ শতাধিক রান ও ১০টির বেশি উইকেট লাভ করেন সাকিব। সঙ্গে ঢুকে যান বিশ্বকাপ ইতিহাসের এক এলিট ক্লাবে, যেখানে সদস্য সাকিব একাই।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে আর কেউই ১ হাজার রান ও ৩০ উইকেট পাননি। সাকিবই একমাত্র।
আরও একটি রেকর্ড গড়েন সাকিব। এক আসরে সাতটি ফিফটি করেন তিনি। কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার বাদে এই কীর্তি নেই আর কারও।
প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টানা চার বিশ্বকাপে দলের প্রথম ম্যাচে ফিফটি করে আরেকটি রেকর্ড গড়েন সাকিব।
সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ দিয়ে শুরু। এরপর নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে ৬৪। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ ভেসে যাওয়ার পর টানা দুই শতক ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। উইন্ডিজের সঙ্গে তার অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংসে ৫১ বল আগেই ৩২২ রান তাড়া করে বাংলাদেশ।
একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেই ফিফটি পাননি সাকিব। সেই আক্ষেপ মেটান আফগানিস্তানের বিপক্ষে।
প্রথমে ব্যাট হাতে ৫১। ব্যাট হাতে টুর্নামেন্ট কাঁপানো সাকিব ম্যাচে আগুন ঝরান বল হাতে। ২৯ রানে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে একাই ধসিয়ে দেন আফগানদের।
ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে হারতে হলেও সে দুই ম্যাচেই হাসে সাকিবের ব্যাট, আসে আরও দুটো ফিফটি।