পাহাড়ী ঢলের পানিতে ভেসে যাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। যে ফসলের ওপর নির্ভর করে সন্তানের পড়াশুনা, চিকিৎসা আর পরিবারের খরচ, সেই ফসল ডুবে যাচ্ছে চোখের সামনেই। এমন চিত্র কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার বিভিন্ন হাওরে।
শনিবার বিকাল থেকেই ঢলের পানি এসে ঢুকছে বিভিন্ন হাওরে। নদীর তীরবর্তী চরগুলো তলিয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না কৃষকেরা। কাঁচি হাতে নিয়ে জমির ফসল কাটবে- সেই উপায়ও নেই৷ কারণ বেশিরভাগ জমির ধান এখনও কাঁচা।
তবে এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ জমি তলিয়ে গেছে তথ্য নেই কৃষি অফিসে। তারা বলছেন, মূল হাওরগুলোতে এখনও পানি ঢুকেনি। নদীর তীরবর্তী চরগুলোই ডুবেছে।
ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামের কৃষক মাফিক মিয়া। বাহিরচর হাওরে জমি করেছিলেন ৪০ শতাংশ। শনিবার বিকাল থেকেই পানি ঢুকতে শুরু করেছে তার জমিতে। শনিবার সকালেও তার জমির অবস্থা ভালো দেখেছিলেন।
মাফিক মিয়া জানান, পরিবারের খরচ চালাতে সারা বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে পৈতৃক জমিটাতে তিনি শ্রম দিতেন। সারা বছরের খোরাক হতো এতে। কিন্তু এইবারের ফসল আর ঘরে উঠল না।
মাফিক বলেন, ‘এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এক তো সব জিনিসের দাম বাড়তি। হারাইলাম জমির ফসলও। অহন বছরটা ক্যামনে চলমু?’
একই এলাকার কৃষক মন্নান মিয়া পাঙ্গাশিয়া হাওরে জমি করেছিলেন চার একর। অন্যের জমি জমা নিয়েছেন টাকার বিনিময়ে। ঢলের পানিতে তার ৪ একরই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পথে৷
মান্নান জানান, সকালে যদি পানি না বাড়ে তবে কিছুটা জমি তিনি কাটতে পারবেন। আর যদি রাতারাতি পানি বেড়ে যায় তাহলে সব হারাবেন।
মান্নান বলেন, ‘খুব টেনশনে আছি। সকালে যতটুকু পারি কাটমু। এজন্য বেশ কয়েকজনকে বলেও রেখেছি।’
বড়হাটি এলাকার কৃষক মুসাহিদ মিয়া। তিনিও অন্যের জমি চাষ করেছেন টাকার বিনিময়ে। মূল হাওরের জমি জমা রাখতে গেলে বেশি টাকা লাগে। সামর্থ্য না থাকায় তাই অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমি চাষ করেছিলেন তিনি। এসব জমিতে পরিশ্রম একটু বেশি লাগলেও ফসল ভালো হয়।
তিনি বলেন, ‘সারা বছর শ্রম দিয়ে জমিতে ফসল ফলিয়েছি। আর এখন চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না।’
মুসাহিদ আরও বলেন, ‘দুই বছর করোনার কারণে বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে কিছু করতে পারিনি। কৃষি জমিই আমাদের একমাত্র সম্বল। কিন্তু অকাল বন্যার সেই সম্বলও ডুবে যাচ্ছে। আমরা এইবার শেষ। এখন নিজেই ক্যামনে চলমু আর পরিবারই বা ক্যামনে চালাইমু?’
ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসা তথ্যমতে উপজেলার বাদলা হাওর, সদর ইউনিয়নের এরশাদনগর, আলালের বন, ধনপুর, বেতেগাসহ এলংজুরী ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকেছে।’
এই কর্মকর্তা দাবি করেছেন, যে জমিগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে বা যেগুলো ডুবেছে সেই জমিগুলো মূল হাওরের জমি না। এইগুলো নদীর তীরবর্তী বা বিভিন্ন খালে চাষ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়, আসামের বিভিন্ন জায়গায় ২৬৭ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি এসে হাওরে ঢুকছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই। তারপরও যে পরিমাণ পানি ঢুকেছে তাতেই আমরা আতঙ্কে আছি। আগামী ২৪ ঘণ্টা পরে যদি আবারও বৃষ্টি হয় তবে বিভিন্ন হাওরের অনেক জমিই তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কি পরিমাণ জমি পানিতে তলিয়েছে তার সঠিক তথ্য আমার কাছে এখনও আসেনি। আজ বিকাল থেকে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে৷ আগামীকাল আমরা সরেজমিনে গিয়ে সঠিক তথ্য জানাতে পারবো।’