বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১২২ বছর বয়সেও তিনি দিব্যি আছেন

  •    
  • ১১ মার্চ, ২০২২ ০৮:৫৬

দীর্ঘ জীবনে কত শত পরিচিতজন, বাবা-মা, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে একে ছেড়ে গেছেন রাম পিরিত রবিদাসকে। শিশুকাল থেকে যাদের দেখে বড় হয়েছেন বা যাদের আদর-ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করেছেন, তারা কেউই আর এ পৃথিবীতে নেই। তবে দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছেন রবিদাস।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, রাম পিরিত রবিদাস তখন ১৪ বছরের তরুণ। দেশভাগ ঘটেছে তার যৌবনে। সোয়া শতাব্দীর স্মৃতি ও বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লেও রবিদাসের মনের শক্তি এখনও প্রবল। সকাল হলে ঘুরে বেড়ান প্রকৃতি দর্শনে। নিজের সব কাজ নিজেই করার পাশাপাশি পরিবারের নানা কাজেও টুকটাক সহায়তা করেন।

মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। ছোট ভাই বুড়ো হয়ে বহুদিন গত হয়েছেন। প্রিয়তম স্ত্রীও সুদূরের স্মৃতি। ১২২ বছর বয়সী রাম পিরিত রবিদাস এখনও অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করেন। এমনকি চশমা ছাড়াই চলে তার।

উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর ধামইরহাট পৌরসভার চকযদু মহল্লার রাম পিরিত রবিদাস জন্মেছেন ১৮৯৯ সালে। তেমনটাই তিনি দাবি করেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্রেও এই সনই লেখা আছে। সে হিসাবে তিনি সারা বিশ্বেই এ মুহূর্তে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ব্যক্তি। কেননা গিনেস বুক অব রেকর্ডসের অফিশিয়াল ওয়েবপেজ অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি জাপানের কেন তানাকার বয়স এখন ১১৯। তানাকা জন্মেছেন ১৯০৩ সালের ২ জানুয়ারি।

গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি জাপানের কেন তানাকা। ছবি: সংগৃহীত

গিনেস বুকের তথ্য বলছে, বিশ্বে এযাবৎকালের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ব্যক্তিটি ১২২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের জঁ লুই কলমেন্ট।

তবে ১২২ বছর বয়সের ব্যাপারে কোনো নথিপত্র নেই রবিদাসের কাছে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাগজপত্র সবই হারিয়ে গেছে তাদের পরিবারের। ভারতের বিহারের একটি স্কুল থেকে ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছেন তিনি। তবে সেই সার্টিফিকেটও তার কাছে নেই।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৮৬৮ সালের দিকে ভারতের বিহার রাজ্যের ছাপড়া জেলার সনপুর গ্রাম থেকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে রাম পিরিত রবিদাসের পিতা গোধন রবিদাস নওগাঁর ধামইরহাটে পরিবারসহ পাড়ি জমান। এরপর চকযদু মহল্লায় জমি কিনে বসবাস করা শুরু করেন তারা। নওগাঁর মাটিতে বেড়ে ওঠেন রাম পিরিত রবিদাস। তবে তাদের বিহারে যাতায়াত বরাবরই ছিল।

১২২ বছরের জীবনে কত শত পরিচিতজন, বাবা-মা, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে একে ছেড়ে গেছেন তাকে। শিশুকাল থেকে যাদের দেখে বড় হয়েছেন বা যাদের আদর-ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করেছেন, তারা কেউই আর এ পৃথিবীতে নেই।

দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক রবিদাস। সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত সময়ে। তাদেরও পরিবারের পরিবার হয়েছে। সব মিলিয়ে চার প্রজন্মের সাক্ষী রাম পিরিত রবিদাস। তার নাতি-নাতনিরও সন্তান হয়েছে। তাদের সঙ্গে পরম সখ্যে কাটে তার জীবন।

রবিদাসের মনের গহিনে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর ও যৌবন স্মৃতিমাখা দিনগুলো নাড়া দেয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে দুই বাংলাকে আবার একত্রিত করার ঘটনা রবিদাসের শৈশবের স্মৃতি। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ সব কিছু তার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

মায়া ও আদরমাখা সময়গুলোর মাঝেও মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ ও একাকী বোধ করেন রবিদাস। বড় ছেলে রাম জনম রবিদাস বলেন, ‘বাবার ছোটবেলার পরিচিতজনরা আর কেউ বেঁচে নেই। বাবা হচ্ছেন আমাদের বংশের সবচেয়ে বেশি বয়সী। ১২২ বছর বয়সেও বাবা কানে শুনতে পান, চোখ দিয়ে চশমা ছাড়াই সবাইকে দেখতে ও চিনতে পারেন। নিজেই লাঠির সাহায্য নিয়ে হাঁটতে পারেন। আবার মাঝে মাঝে লাঠি ছাড়াও চলাফেরা করেন।

‘বাবার তেমন কোনো গুরুতর অসুখ নেই। তবে বয়স হলে মানুষের স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতিশক্তি বা শারীরিক শক্তি কমে যায়। তেমনটাই হয়েছে বাবার ক্ষেত্রেও। তবুও বাবা সবাইকে চিনতে পারেন। সবার সঙ্গে কথা বলেন।

‘বাবা মাঝে মাঝে খুব একাকিত্ব বোধ করেন। তার কারণ হচ্ছে, বাবার সঙ্গে যাদের ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা, তারা সবাই পরপারে চলে গেছেন। বাবা এসব ভেবে মনে খুব কষ্ট অনুভব করেন। তবে আমরা তো আছি। বাবাকে নিয়ে সবাই খুব সুখেই আছি। আমাদের যা জমিজমা আছে, সেগুলো চাষাবাদ করেই সংসার চলে। বাবাকে বয়স্কভাতাও দেয়া হয়।’

রবিদাসের নাতি রাজেন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘আমি সত্যিই খুব সৌভাগ্যবান ও গর্বিত যে দাদুর আদর-ভালোবাসা পেয়ে আসছি ছোটবেলা থেকে। বিয়ে করেছি, সন্তান ও পরিবার হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক কিছুই দাদুর কাছে থেকে শুনেছি।’

রাজেন্দ্রনাথের স্ত্রী বাসন্তী রানী বলেন, ‘আমার দাদাশ্বশুর যে ১২২ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া। আমার নিজের দাদাকেই ছোটবেলায় হারিয়েছি।’

কথা কিছুটা অস্পষ্ট হলেও রাম পিরিত রবিদাস শৈশবের স্মৃতিচারণা করলেন। বললেন, ‘বেঁচে আছি তো সৃষ্টিকর্তার পরম কৃপায়। নইলে কবে আমার দেহ চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে যেত।’

তিনি বলেন, ‘২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের অধীনে থাকার পর ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাংলার মানুষ। সে সময় আমার বয়স খুব কম ছিল। আর বাপ-দাদার কাছে থেকে আরও ভালোভাবে জেনেছিলাম। বাপ-দাদার আমলে তো ব্রিটিশ শাসন খুব জোরদার ছিল। তারা তাদের মতো করে শাসন করত, অত্যাচার করত, সবকিছু ভোগ করত।

‘ব্রিটিশের পর এ দেশে পাকিস্তান শাসন করার চেষ্টা করে। বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। দেশ তাদের দখলে নিতে চেয়েছিল। কত মুক্তিকামী মানুষকে তারা মেরে ফেলেছিল, নির্যাতন-নিপীড়ন করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আর পাকিস্তান কেউই সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত।’

তিনি বলেন, ‘যখন ভাবি আমার সন্তান, নাতি-নাতনিরা আছে, তাদের সঙ্গে থাকছি, তখন ভালো লাগে। আবার যখন ভাবি আমার মা, বাবা, ভাই, বন্ধুবান্ধব আর পরিচিতরা মারা গেছেন, শুধু আমি বেঁচে আছি, তখন কেমন জানি খুব খারাপ লাগে। কষ্ট লাগে।’

রবিদাস বলেন, ‘মানুষ তো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে। স্মৃতির মাঝে বসবাস করে। আমার প্রজন্মে কেউ নেই, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না, দেখা করতে পারি না, মন খুলে গল্প করতে পারি না। এসব ভাবনা আমাকে মাঝে মাঝে খুব ব্যথা দেয়, কাঁদায়।’

এলাকার অন্য বয়স্করা কী বলেন

এলাকায় বসবাসকারী কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তারা অবশ্য যে স্মৃতিচারণা করেছেন, তাতে রবিদাসের বয়স ১২২ প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন।

স্থানীয় ৮৫ বছর বয়সী কমল তেওয়ারী বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৫-১৬ বছর ছিল, তখন রবিদাস দাদার বয়স ছিল ৩০-৩৫ বছর। সে সময় রবিদাস দাদা দুরন্ত যুবক ছিলেন।’

কমল তেওয়ারির বক্তব্য অনুযায়ী দুজনের বয়সের তফাৎ সর্বোচ্চ ২০ বছর হলেও রবিদাসের বর্তমান বয়স দাঁড়ায় ১০৫ বছর।

অখিল সরকার নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বর্তমান বয়স প্রায় ৭৫ বছরের মতো। আমার বয়স যখন ১৪-১৫ বছর, তখন রবিদাস দাদার বয়স মোটামুটি ৩৫-৩৬ বছর হবে।’

এ হিসাবেও রবিদাসের বয়স ১০৫ বছরের আশপাশে দাঁড়ায়।

তবে এলাকার সবাই স্বীকার করেছেন, তিনি ওই এলাকার যেকোনো বয়স্ক ব্যক্তিটির চেয়েও অনেক বেশি বয়সী।

দীর্ঘায়ু নিয়ে বিজ্ঞান কী বলে

বিজ্ঞান বলছে, বার্ধক্য বা জরা একটি জীবদৈহিক অমোঘ প্রক্রিয়া। মানব শরীরের কোষগুলো পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বিভাজিত হয় বা বেঁচে থাকে। নির্ধারিত বয়সের পর এ প্রক্রিয়া থেমে যায়। বুড়িয়ে যাওয়াকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই দেখছে বিজ্ঞান।

সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। বাংলাদেশেও এ মুহূর্তে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর।

তবে কোনো কোনো দেশ বা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দীর্ঘজীবী ব্যক্তির সংখ্যা বেশি দেখা যায়। ইউরোপের ক্ষুদ্র দেশ মোনাকোতে নাগরিকদের গড় আয়ু ৮৯ দশমিক ৪ বছর। জাপানে এটি ৮৫ দশমিক ৩ বছর। এর পরেই রয়েছে সিঙ্গাপুরের অবস্থান। সেখানে মানুষ গড়ে ৮৫ দশমিক ২ বছর বাঁচে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের আয়ু জিনবিদ্যা, পরিবেশ এবং জীবনধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরিবেশগত উন্নতি, বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানির সরবরাহ, উন্নত আবাসন, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগের সংস্পর্শ হ্রাস এবং চিকিৎসা পরিষেবার প্রাপ্যতার কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।

তবে জিনগত কারণে কিন্তু কিছু ব্যক্তি অস্বাভাবিক বেশি সময় বেঁচে থাকেন।

সুস্থ জীবনযাপন দীর্ঘায়ুর মূল হাতিয়ার

একজন মানুষের জীবনের আয়ু কেমন হবে তা অনেকটা নির্ভর করে তার বংশগতি, পরিবেশ ও জীবনযাপনের ওপর। ৯০ থেকে ১০৫ বছর বয়সী মানুষের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, তাদেরকেও অন্য সবার মতো শিক্ষা, জীবিকা, ঘর-সংসারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে তাদের সবাই ছিলেন অধূমপায়ী, মুটিয়েও যাননি কেউ।

জীবন চলার পথে যে চাপ সইতে হয়েছে, তা ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছেন তারা। তবে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী। তাদের বয়সজনিত উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগে ভুগতে হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইয়ারুল কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের আয়ু ভৌগোলিক অবস্থা, পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ অনেকগুলো বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে। দেশে অনেক মানুষ রয়েছে ১০০ বছরেও বুড়ো হয় না। আবার ৫০ বছরেও অনেক মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। এর পেছনে জিনগত কারণ কিছুটা দায়ী। এ ছাড়া খাদ্যাভ্যাস অনেকটা প্রভাব ফেলে।’

তিনি বলেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু, তাদের জীবনাচরণ লক্ষ করলে দেখবেন, তারা তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নিয়মিত শরীরচর্চা করেছেন। তাদের চিন্তাধারা ভালো ছিল। দীর্ঘজীবী হতে হলে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস একটি নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। এ ছাড়া আপনি দূষিত পরিবেশ, ধূমপান ও মদ্যপান করে দীর্ঘ জীবন আশা করতে পারেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগের যুগের মানুষের আয়ু কম ছিল। ধীরে ধীরে এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিছু সেটা বেড়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর