বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশুর লাশ: কোনো কথাই মেলে না মাদ্রাসাশিক্ষকদের

  •    
  • ৭ মার্চ, ২০২২ ২০:৪৮

মাশফির মামা মাসুদ খান বলেন, ‘জাফর হুজুর বলছেন, সাতটার দিকে আমার ভাগনেকে টয়লেটে যেতে অনুমতি দিয়েছেন। আর সাড়ে সাতটায় মাদ্রাসা ছুটি দিয়েছেন। কিন্তু উনি সাড়ে সাতটায় ছিলেন আমাদের বাড়িতে। সময়ের একটা গরমিল হচ্ছে। … হুজুর বলছে যে চারজন ছাড়া একটা ছাত্রকে বের হতে দেয় না, কিন্তু এখন বলছে মাশফি একা গেছে। মাশফি একা কেমনে যাবে?’

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে কওমি মাদ্রাসায় শিশুর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় সেখানকার শিক্ষকরা পরিবারের কাছে যেসব কথা বলেছেন, তার সঙ্গে ছাত্রদের বর্ণনা মিলছে না। আরও নানা অসংগতি উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।

মাদ্রাসা থেকে শিশু ইফতেখার মালিকুল মাশফিকের গলাকাটা দেহ উদ্ধার করা হয় গত শনিবার। তার মৃত্যু কীভাবে হলো, এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, সেই বিয়ষটি খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এরই মধ্যে এক শিক্ষককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। এ বিষয়ে তার পরিবার, মাদ্রাসাশিক্ষকসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়।

মাদ্রাসাপ্রাঙ্গণে কোন প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কোথায়

মাজারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে একটু এগোলেই হাতের বাম পাশে শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকীর রওজা (কবর)। বাম পাশে মাঝারি আকারের একটি পুকুর। সবকিছু গড়ে উঠেছে রওজাকে ঘিরেই।

রওজার সঙ্গে একই ভবনে মসজিদ, তার নাম গাউসুল আজম মাইজভান্ডারি। মসজিদের উত্তর পাশে শাহ অছিয়র রহমান হেফজখানা ও এতিমখানা। হেফজখানা ও মাসজিদের সামনে একটি ছোট্ট খোলা মাঠ।

মাঠের উল্টো দিকে মাওলানা শাহ অছিয়র রহমানের বংশধরদের বসতবাড়ি। এর দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে শাহ অছিয়র রহমান স্মৃতি অ্যাকাডেমি। তবে অ্যাকাডেমিতে যেতে হয় মূল রাস্তা দিয়ে ঘুরে।

মাশফির নিখোঁজ হওয়া

সময়- ভোর ৫টা ৩৫।

মাওলানা শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকীর মাজারসংলগ্ন মসজিদে হয় ফজরের নামাজ। প্রার্থনা শেষে মাজার জিয়ারত ও মুনাজাতে অংশ নেয় ছাত্ররা। পরে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ছাত্রদের ছবক (তালিম) দেয়া হয়।

সেদিন ছবক দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন মাদ্রাসাশিক্ষক হাফেজ আবু জাফর।

মাশফির পরিবারের কাছে তার দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, সকাল ৭টায় মাশফি বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে ছুটি নেয়। তার সঙ্গে ছিল আরও তিনজন।

সকালের নাশতার জন্য মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বিরতি দেয়া হয় সকাল সাড়ে ৭টায় । এরপর মাশফির নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারেন জাফর হুজুর।

সে বাড়িতে গেছে কি না খোঁজ করতে মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থীকে দেড় কিলোমিটার দূরে ফকিরাখালী এলাকায় মাশফির নিজ বাড়িতে পাঠান তিনি। এর পরপরই প্রায় ৭০০ মিটার দূরে চরণদ্বীপ পাঠান পাড়ায় মাশফির নানার বাড়িতে মাশফিকে খুঁজতে যান জাফর হুজুর নিজেই।

যদিও হুজুরের কাছে মাশফির মা ও ভাইয়ের মোবাইল নম্বর ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে ফোন না দিয়ে নিজেই ছুটে যান।

মাশফির নানাবাড়িতে কী কথা

জাফর হুজুর মাশফির নানাবাড়িতে গিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শিশুটির ছোট মামা মাসুদ খানকে। ভাগনের নিখোঁজের কথা শুনে হুজুরের সঙ্গে তিনিও মাদ্রাসায় গিয়ে খোঁজা শুরু করেন।

এর মধ্যে মোবাইল ফোনে মাশফির বড় ভাই ইমতিয়াজ মালেকুল মাজেদকে জানান মাসুদ। তিনি বিষয়টি শুনে মাদ্রাসার কাছাকাছি দুই বন্ধুকে মাদ্রাসায় পাঠান এবং নিজেও রওনা দেন।

যেভাবে মাদ্রাসায় পাওয়া গেল মরদেহ

তারা মাদ্রাসায় যখন এসে পৌঁছান, তখন সময় ৮টা ১৪ মিনিট।

মাশফির মামার ফোনে ওই সময়ে একটি কল আসায় সময় জানাতে পারেন তিনি। মূল ফটক দিয়ে মাদ্রাসায় ঢোকার সময় শুনতে পান কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে ‘পা দেখেছি’, ‘পা দেখেছি’।

এরপর মাদ্রাসার দোতলায় যান মাসুদ খান। সেখানে দুই ছাত্রের সঙ্গে রুস্তম হুজুর ও শাহাদাত হুজুরকে দেখতে পান। তখন হুজুরের হাতে ছিল লোহার রড।

সেই হুজুর জিনের সমস্যার কথা বলে সবাইকে আজান দিতে বললে দুই ছাত্র ও মাসুদ খান আজান দেয়া শুরু করেন।

পরে মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ দিকে লেপ মোড়ানো অবস্থায় পা দেখতে পান দুই ছাত্র। লেপ উল্টে মাশফিকে দেখে চিৎকার দেয় তারা।

এর মধ্যে মাশফির ভাই ও আশপাশের আরও বেশ কয়েকজন যান মাদ্রাসায়।

এরপর মাসুদ মাশফিকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে গলা কাটা দেখতে পান। দ্বিতীয় তলায় অন্ধকার হওয়ায় শুরুতে মাশফির গলা কাটা খেয়াল করেননি তিনি।

এলো পুলিশ, মেলে না হুজুরের বর্ণনা

এর বেশ কিছু সময় পর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। জাফর হুজুর ও রুস্তম হুজুর পুলিশকে জানান, ঘটনার পর থেকে দুই শিক্ষার্থী নিখোঁজ আছে, তারাই ঘটনাটি ঘটাতে পারে।

কিন্তু পরে জানা যায়, ওই দুজন শিক্ষার্থীকে দেড় কিলোমিটার দূরের মাশফির বাড়িতে তাকে খোঁজার জন্যই পাঠিয়েছিলেন জাফর হুজুর। কিন্তু হুজুরের বর্ণনার সঙ্গে শিক্ষার্থীর বর্ণনায় কিছু অমিল খুঁজে পায় পুলিশ।

ওই মাদ্রাসার অপেক্ষাকৃত সিনিয়র চার শিক্ষার্থীর একজন ইদু আলম সাকিব। যে দুই শিক্ষার্থীকে মাশফির বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল, তাদের একজন এই সাকিব। তার সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।

সাকিব জানায়, নামাজের পর জিয়ারত শেষে ছবক দেয়ার ৩ থেকে ৪ মিনিট পর মাশফি বাথরুমে যাওয়ার জন্য ছুটি নেয়। তখন ঘড়িতে সময় ভোর ৬টা ৩৫ মিনিট।

মাশফিকে রুম থেকে বের হয়ে মাদ্রাসার বারান্দা পর্যন্ত যেতে দেখেছে সে। তবে এ সময় মাশফি একাই ছিল, সঙ্গে আর কেউ ছিল না।

পরে খাবারের ছুটি দেয়া হলে কয়েকজন সহপাঠী সাকিবকে জানায়, মাশফি নেই। তখন বিষয়টি জাফর হুজুরকে জানায় সাকিব।

হুজুর তখন মাদ্রাসায় দুই তলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে চেয়ারে বসে ধূমপান করছিলেন। এর মধ্যে আরও একাধিক ছাত্র বাথরুমে গিয়েছিল। সেখান থেকে এসে মাশফিকে না দেখার কথাও হুজুরকে বলেছিল তারা।

তখন হুজুর বিষয়টা নিয়ে কিছু বলেননি। খাবারের ছুটিতে মাশফিকে না পাওয়ার বিষয়টি জেনে সাকিব ও আবু তাহের নামের এক ছাত্রকে তার বাড়িতে খুঁজতে পাঠান হুজুর।

সাকিব মাশফির বাড়ি ও বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলে খুঁজে ফের মাদ্রাসায় এসে জানতে পারে, শিশুটির লাশ পাওয়া গেছে। ততক্ষণে পুলিশও চলে এসেছে। এ সময় সে ভেতরে যেতে চাইলেও পুলিশ তাকে ভেতরে যেতে দেয়নি।

বাচ্চাকে জিনে ধরেছে বলে আজান

মাদ্রাসার পরিচালক সানাউল্লাহ ফারুকী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুরু থেকে শিক্ষকরা বলছিলেন কোনো বাচ্চাকে জিনে পেয়েছে- এ রকম । তারপর আজানও দেয়া হয়। পরে আমরা গিয়ে দেখি মাশফির লাশ পড়ে আছে।

‘আমাদের শিক্ষক আছেন তিনজন, এর মধ্যে দুজন হেফজ বিভাগের ও একজন অ্যাকাডেমির। অ্যাকাডেমির যে শিক্ষক, তিনি কেবল হেফজখানায় অবস্থান করেন।’

মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় একটি বিছানা রয়েছে বলে জানান মাশফির ভাই ইমতিয়াজ মালেকুল মাজেদ।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসার পরিচালক সানাউল্লাহ ফারুকী বলেন, ‘আমরা এটা বলতে পারছি না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটা তদন্ত করছে। আশা করি ভালো একটা প্রতিবেদন দেবে।’

শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় শারীরিক নির্যাতনের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে হয়তো হেফজখানায় কোনো বাচ্চাকে শাস্তি দিয়েছে। এ রকম অভিযোগ মাঝে মাঝে আসত। শিক্ষকদের যেভাবে শাসন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়, তারা সেভাবেই করতেন। কখনও বড় সমস্যা হয়নি। বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যৌন হেনস্থার কোনো অভিযোগ আমরা কখনও পাইনি।

‘অনেক আগে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ পাওয়ায় আমরা তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করেছি। বর্তমান তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ কখনই ছিল না।’

শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের নিয়ম অনুযায়ী মারধর করার সুযোগ নেই, যদিও হেফজখানা ও মাদ্রাসাগুলোতে আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের মারধর করার প্রথা চলে আসছে। কিন্তু আমরা হুজুরদের কাউন্সেলিং করতাম। শিক্ষার্থীদের বলে-বুঝিয়ে পড়াতে হবে, মারধর করা যাবে না- এসব আমরা সব সময় শিক্ষকদের বোঝাতাম।’

মাশফির ভাইয়ের অভিযোগ মাদ্রাসায় শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হতো।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেখানে থাকে, সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন হলে তারা ঝাড়ু দেয়া বা এই ধরনের কাজগুলো সাধারণত করত।’

তবে এসব কাজের জন্য মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

কথায় অনেক গরমিল: মাশফির ভাই

মাশফির বড় ভাই ইমতিয়াজ মালেকুল মাজেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই কখনও মাদ্রাসায় মারধরের কথা আমাদের বলেনি। তবে মৃত্যুর কয়েক দিন আগে দুষ্টুমি করায় তাকে একটু মেরেছে বলে জানায় সহপাঠীরা। এ রকম একটা ঘটনা হবে কল্পনাও করিনি।’

সন্দেহের তালিকায় কারা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক তিনজন আর মাদ্রাসার বড় ছেলেরা। সবচেয়ে বেশি জাফর হুজুর। কারণ, উনিই দুই তলায় সিগারেট খেতে যেতেন। ওই জায়গাটাতে তিনি সিগারেট খেতেন। এখনও সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে সিঁড়ির নিচে।’

মাশফির মামা মাসুদ খান বলেন, ‘জাফর হুজুর বলছেন, সাতটার দিকে আমার ভাগনেকে টয়লেটে যেতে অনুমতি দিয়েছেন। আর সাড়ে সাতটায় মাদ্রাসা ছুটি দিয়েছেন। কিন্তু উনি সাড়ে সাতটায় ছিলেন আমাদের বাড়িতে। সময়ের একটা গরমিল হচ্ছে।

‘সব দিকে খুঁজেটুজে যখন আমি মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম, তখন ৭টা ৫৪ বাজে। পরে বাইর থেকে যখন আবার মাদ্রাসায় আসি, তখন ৮টা ১৪ মিনিট। ওই সময় আমি একজনকে কল দিয়েছিলাম।

‘আমরা কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করছি না, কিন্তু তাদের একটা ঘাটতি আছে। ওরা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছে, কিন্তু সচল না৷

‘তারপর বাচ্চারা যে পড়াশোনা করতেছে, তাদের জন্য বাথরুম ভেতরে থাকা দরকার। এখন বাথরুম মাদ্রাসা থেকে ১০০ থেকে ১৫০ গজ দূরে। হুজুর বলছে যে চারজন ছাড়া একটা ছাত্রকে বের হতে দেয় না, কিন্তু এখন বলছে মাশফি একা গেছে। মাশফি একা কেমনে যাবে? চারজন ছাড়া যে বের হতে দেয় না, এটা জাফর হুজুর বলেছেন, কমিটিও বলছে।’

গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে যারা

মাদ্রাসাছাত্র ইফতেখার মালিকুল মাশফিকে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের নামে মামলা করেছেন মামা মাসুদ খান। এ ঘটনায় তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

সব কোশ্চেনের জবাব জানান চেষ্টা করছি: তদন্ত কর্মকর্তা

মামলাটি তদন্ত করছেন বোয়ালখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে জাফর রিমান্ডে আছেন। আমরা তার কাছ থেকে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না দেখছি।‘

জিজ্ঞাসাবাদে কী জানা গেল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটা তদন্তাধীন, তাই আমি এখন খোলাখুলি সেভাবে কিছু বলতে পারছি না। এতটুকু বলি যে আপনাদের যা যা কোয়েশ্চেন, সেসব কোয়েশ্চেনের উত্তর আমরাও বের করার চেষ্টা করছি। দ্রুতই সবকিছু বের হবে আশা করি।’

এ বিভাগের আরো খবর