বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দৃষ্টি নেই, তবু ছড়াচ্ছেন জ্ঞানের আলো

  •    
  • ১৯ আগস্ট, ২০২১ ০৮:৪৭

‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, পথে পথে যে আলো জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরেই নেই যার আলো জ্বালাবার সামর্থ্য।’

চোখের আলো হারিয়ে গেছে দেড় দশকের অধিক আগে, তবু দিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের আলো। করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর।

ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর সদরের গণিতের শিক্ষক মো. শওকত আলী। প্রাইভেট শওকত মাস্টার নামে পরিচিত। অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা করতে পারেননি বেশি দূর। কিন্তু এ পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে দিয়েছেন পথের দিশা।

২০০৫ সালে হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। রেটিনার নার্ভ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারান। বাংলাদেশ ও ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। এতে দৃষ্টি না ফিরে পেলেও শেষ হয়েছে সব সঞ্চয়। পরে অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি।

আত্মমর্যাদা বোধের কারণে কারও কাছে হাত পাতেননি। উন্নত চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন। থেমে নেই তার জ্ঞান ছড়ানোর ব্রত। অন্ধত্ব নিয়েও পড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। দিব্যি ব্লাকবোর্ডে কষে যান গণিতের জটিল সব সমাধান। শিক্ষার্থীর দুর্বল দিককে চিহ্নিত করে মেধানুযায়ী পাঠদান সহজ করে উপযুক্ত করে গড়ে তোলায় এ শিক্ষকের বড় সাফল্য।

আশির দশকে মাগুরা থেকে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বোয়ালমারীতে আসেন শওকত আলী। আত্মীয়তার সূত্রে উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম শেখ আক্কাস আলীর পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর দায়িত্ব নেন। তার তত্ত্বাবধানে এ পরিবারের সবাই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

১৯৮৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ১০ জন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিয়ে কোচিং শুরু করেন। এরপর আর থামার অবসর পাননি। থেকে যান বোয়ালমারীতেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতা।

সে সময় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসএসসিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগে থাকত। এসব ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকদের কাছে ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন শওকত আলী।

আবাসিক-অনাবাসিক মিলে কোনো কোনো বছর ১০০-১৩০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ব্যাচ করে পড়াতেন। শিক্ষার্থীর চাপে এক সময় নাওয়া-খাওয়া সময় না পেলেও দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর থেকে ধীরে ধীরে কমে আসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা। বর্তমানে ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি।

তার কাছ থেকে শিক্ষার আলো নেয়া অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার, এমবিবিএস ডাক্তার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ।

এখন মাত্র ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি। এর থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে বাসাভাড়ার পর কষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে দিন পার করতে হয় তাকে।

দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ঢাকায়। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও যা আয় হয় তাতে নিজের চলতেই কষ্ট হয়।

ইচ্ছা ছিল এক টুকরো জমি কিনে নিজের একটা বাড়ি করার। কিন্তু চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চিত টাকার সবটাই শেষ হয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসা করানো গেলে দৃষ্টি ফিরে পাবার সম্ভাবনা ছিল। অর্থের অভাবে ভারত ছাড়া দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে রেটিনার নার্ভ শুকিয়ে ক্ষীণ আশাটিও এখন মৃতপ্রায়।

শওকত আলী জানান, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজের বা সংসারের কথা চিন্তা করিনি। কয়েক শ গরিব ছেলে-মেয়েকে বিনা বেতনে পড়িয়েছি। এসএসসিতে ফর্ম ফিলাপ করতে অপারগ ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আর এখন নিজেই চলতে পারি না।

সত্যি বলতে কী, 'আমি ভীষণ কষ্টে আছি। কষ্টে আছি! আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, পথে পথে যে আলো জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরেই নেই যার আলো জ্বালাবার সামর্থ্য।'

এ বিভাগের আরো খবর