বঙ্গোপসাগর থেকে একের পর এক মাছ ধরার নৌকা ভিড়ছে সৈকতে। ঝুড়িভর্তি ইলিশ ও চোখেমুখে তৃপ্তি নিয়ে তীরে নামছেন জেলেরা।
মাছ ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন ইলিশ গোছাতে। কেউ ইলিশের স্তূপে দিচ্ছেন বরফ, কেউ কেউ ঝুড়িতে গুনে গুনে ভরছেন ইলিশ। জেলে, ব্যবসায়ীদের হই-হুল্লোড়ে চারদিক উৎসবমুখর।
এদিকে ইলিশ মিলছে না বলে অলস সময় কাটাচ্ছেন পদ্মা-মেঘনার জেলেরা। যতটুকু মিলছে, তাতে নৌকার খরচই উঠছে না বলে অভিযোগ তাদের।
কক্সবাজারের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এই চিত্র গত এক সপ্তাহ ধরে। ফিশারি ঘাট নামে পরিচিত এই কেন্দ্রের মোকাম এখন রুপালি ইলিশে ভরপুর। বেচাকেনা জমে ওঠায় তিন মাস পর প্রাণ ফিরে এসেছে সেখানকার আড়তগুলোতে।
বৈরী আবহাওয়া ও ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গেলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছিল না জেলেরা। এক সপ্তাহ ধরে হঠাৎ যেন ইলিশ মিলতে শুরু করেছে। শত শত ফিশিং বোটে এ কয়দিন সাগরে গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরছেন জেলেরা।
ফিশারি ঘাটে বুধবার গিয়ে কথা হয় জেলেদের সঙ্গে। এফবি-১ ট্রলারের জেলে মোহাম্মদ রায়হান বলেন, ‘ইলিশ মাছে দাম ভালোই পাচ্ছি। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার সাগরে অনেক বড় বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তা দেখে মনে ভরে যাচ্ছে।’
ছেনুয়ারা ট্রলারের মাঝি নুর মোহাম্মদকে খুব ব্যস্ত দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘সাগরে জাল ফেললেই বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। মাছ ধরে দ্রুত বিক্রি করার জন্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে এলাম। বিক্রি করে আবার ট্রলারে বরফ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাব।’
আরেক জেলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘সাগরে ইলিশ আর ইলিশ। গেল ১০ দিনে জাল ফেলে ৩ হাজারের বেশি ইলিশ ধরেছি।’
এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে রয়েছে মাছ রাখার দুটি শেড। বুধবার দুপুরে দেখা গেল, এসব শেড ইলিশে ভর্তি। বাধ্য হয়ে খোলা মাঠে ইলিশ এনে রাখছেন ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ এহেছানুল হক জানান, গেল পাঁচ দিনে প্রায় ৪০০ টন মাছ অবতরণ হয়েছে। এর মধ্যে ইলিশই ছিল আড়াই শ টনের বেশি।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ ছিল। এ কারণে ইলিশের প্রজনন ও আকৃতি বেড়েছে অনেক গুণ।
‘গত বছর জেলায় ইলিশ আহরণ হয়েছিল ১৫ হাজার ২৫৬ টন। এবার লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার টন। আশা করছি জেলেরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকায়। ১০০ ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক থেকে দেড় লাখ টাকার ওপরে।’
বিপরীতে ইলিশের সংকট প্রভাব ফেলেছে দেশের অন্যতম বড় ইলিশের বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটে। মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে এখন ফতুর হওয়ার পথে।
বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে ৫ থেকে ৬ হাজার মণ ইলিশ আহরণ করলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ মণে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় ইলিশের দাম বেশ চড়া।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান জানান, পদ্মা-মেঘনা পানিদূষণের পাশাপাশি নদীতে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচর থাকায় ইলিশ চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ইলিশ নদীতে কম আসছে।
তবে আগস্টের শুরু থেকে সাগর ও উপকূলের জেলাগুলোতে ইলিশ পাওয়া শুরু করেছেন জেলেরা। অচিরেই চাঁদপুরের জেলেরাও পর্যাপ্ত ইলিশ পাবেন।
বরিশালের জেলেরাও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ। সেখানকার ইলিশ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, মোহনায় নাব্যতা হ্রাস ও বরিশালের নদ-নদীগুলোতে পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় ইলিশের এই সংকট।
তারা বলছেন, ইলিশ গভীর জলের মাছ হওয়ায় কম পানিতে এসব মাছ থাকছে না। তা ছাড়া মোহনায় অসাধু জেলেরা বিভিন্ন জাল ফেলে রাখার কারণেও নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ছে।
নদীতে ইলিশের এই আকাল অস্বাভাবিক নয় বলেই জানালেন বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। প্রতিদিন বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে হাজারের বেশি মণ ইলিশ আসছে। তবে নদীতে কিছুটা কম রয়েছে মাছ।
‘এই সময়টাতে ইলিশ সাগরেই বেশি থাকে। ডিম ছাড়ার জন্য যখন সাগর থেকে নদীতে ইলিশ আসবে, তখন ডিম ছাড়ার পর নদীতে ইলিশ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পূর্ণিমা এলে নদীতে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’