একসময় ছিল প্রবহমান নদী। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দখল ও ভরাটে সেই নদী পরিণত হয় ধানের জমি, গো-চারণভূমিতে। আবার কোথাও ছোট খাল ও পুকুরে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে ছিল বসতবাড়িও।
সেখানেই এখন স্বচ্ছ পানির স্রোত। নদীর বুকে খেলা করে হাঁস, ঝাঁকে ঝাঁকে আসে বক, বেড়েছে পাতি সরালি আর মাছরাঙার আনাগোনাও।
খননের পর প্রায় ২০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে মানুষের দখলে চলে যাওয়া রংপুরের ‘মরা তিস্তা’ আর ‘ঘিরনই নদী’তে ফিরেছে প্রাণ।
রংপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া নদী দুটির ১৭ কিলোমিটার গত অর্থবছরের (২০২০-২০২১) জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার এবং তা খনন করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।
শুধু নদী খনন নয়, দুই পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।
বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘মরা তিস্তা’ খননের পর উৎসমুখ চিকলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর ঘিরনই নদীর ৩ দশমিক ২৬৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। দুটি নদীই যুক্ত হয়েছে যমুনেশ্বরী নদীতে।
শুধু নদী নয়, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য যমুনেশ্বর ও চিকলী নদীর মিলনস্থলে বিলের ১১ দশমিক ৫৯ একর খাস জমি উদ্ধার করে তা খনন করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয়রা দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে পারছেন। বিলে হাঁস ও মাছ চাষের পাশাপাশি সঞ্চিত পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মরা তিস্তা নদী
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৭৭৬ সালের রেলের মানচিত্রে তিস্তার একটি শাখা পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে বর্তমান নীলফামারীর ডোমার উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। নদীটি নীলফামারী অতিক্রম করে রংপুরের তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষ ভাগে করতোয়া নদীতে মিলিত হয়। এটিই ‘মরা তিস্তা’ নদী নামে পরিচিতি পায়।
খননের আগে মরা তিস্তা নদী। ছবি: নিউজবাংলা
১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় তিস্তা তার গতিপথ বদলায়। এতে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। তিস্তা নামের বদলে স্থানীয়ভাবে হয়ে যায় দেওনাই, চাড়ালকাটা ও যমুনেশ্বরী। যুগে যুগে মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় বসতভিটা, পুকুর, ধানের জমি, গো-চারণভূমিতে পরিণত হয় নদীটি।
বন্যার সময় পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় নদীর পার্শ্ববতী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়ত মানুষ। জলাবদ্ধতা ও বন্যায় নষ্ট হতো হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল।
বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ জানায়, নদীটি খননের পর বর্তমানে এটি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা সদরের শ্মশানঘাটসংলগ্ন চিকলী নদী থেকে প্রবাহিত হয়ে উপজেলা পরিষদের পাশ দিয়ে জামুবাড়ী, বালুয়াভাটা, শংকরপ্রু, ঝাড়পাড়া, সরকারপাড়া, কালুপাড় ও বৈরামপুর এলাকা হয়ে কুতুবপুর ইউনিয়নের কাঁচাবাড়ীর পূর্বদিকে কুঠিপাড়া ঘাটের কাছে যমুনেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে।
নাব্যতা সংকট কাটায় বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে বদরগঞ্জ উপজেলা সদর। এ ছাড়া বদরগঞ্জ উপজেলার গোপীনাথপুর ও রামনাথপুর ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত গড্ডাংগী নদীও মরা তিস্তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। খননের পর এটিও এখন প্রবহমান একটি নদী।
ঘিরনই নদী
কালের বিবর্তনে ঘিরনই নদীও নালা বা খালে রূপ নিয়েছিল। নদীটির বর্তমান উৎপত্তিস্থল নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের বিলাঞ্চলে।
উৎপত্তিস্থল থেকে ৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর মুচিরহাট এলাকা দিয়ে বদরগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে এটি। নদীটি করতোয়া নামে রংপুর-দিনাজপুর সীমানা বরাবর ৩৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বদরগঞ্জের বকসীগঞ্জ সেতুর উজানে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা হয়ে সোনারবান (সোনারবন্ধ) নামে অপর একটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।
এই মিলিত প্রবাহ ‘ঘিরনই’ নামে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর ও লোহানিপাড়া ইউনিয়নের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউনিয়নে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ঘিরনই নদীটির দৈর্ঘ্য ৪৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিএডিসি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন অংশ খনন করেছে।
বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ ‘ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প (ইআইআরপি)’ এর আওতায় চলতি বছর (২০২০-২০২১) নদীটির আরও ৩ দশমিক ২৬৫ কিমি পুনর্খনন করে।
ভাড়ারদহ বিল
একসময় বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা তথা বর্তমান যমুনেশ্বরী নদীর ঘূর্ণিময় অংশ ও চিকলী নদীর মিলনস্থলে ছিল ‘ভাড়ারদহ বিল’।
তিস্তা ও যমুনেশ্বরী নদীর পথ পরিবর্তনের ফলে যমুনেশ্বরীর ঘূর্ণিময় অংশটি বিলে পরিণত হয়। এটি বদরগঞ্জের ডাংগাপাড়া, যুগিপাড়া ও সাহাপুর গ্রামবাসীর একমাত্র বিল ছিল।
ধীরে ধীরে বিলটি জলাভূমিতে পরিণত হয়। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বিলটি দখলে নিয়ে কৃষিজমিতে পরিণত করেন।
ইআইআরপি প্রকল্পের আওতায় বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ ১১ দশমিক ৫৯ একরের বিলটিও উদ্ধার করেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি এখানে খনন শুরু হয়। শেষ হয় জুনে। বিলটি পুনর্খননের মাধ্যমে দখলমুক্ত হওয়ায় বর্তমানে ‘ভাড়ারদহ বিল’ হিসেবে ফের পরিচিতি পেয়েছে।
একসময়ের গো-চারণভূমি ফের নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফিরে পেয়েছে নদীর অবয়ব। বেঁধে দেয়া হয়েছে দুধারের পাড়। সেখানে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
স্থানীয় সাইফুল ইসলাম জানান, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন মরা তিস্তা নালার মতো একটি খাল। অনেকে সেখানে ধান চাষ করছেন। অল্প বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে এলাকা পানির নিচে চলে যেত। পানি বের হতে না পেরে এ অবস্থা তৈরি হতো।
তিনি আরও জানান, এখন আর পানি আটকাবে না। দ্রুত নেমে যাবে। ফসলের ক্ষতিও আর হবে না।
খলিলুর রহমান নামে আরেকজন ঘিরনই নদী নিয়ে বলেন, ‘এই নদীত আগে আবাদি জমি ছেল। আগে আব্বা জমিত আবাদ করছে। আমরাও আবাদ কচ্ছিনুং।
‘এবার তো ওমরা নদী বানাইল। এলা আর কী, নদী থাকলে যা হয় তাই হইবে। পানি থাকপে, মাছ থাকপে, পাট জাগবার পামো এই আরকি…।’
মফিজা বেগম বলেন, ‘আগোত তো ধান চাষ করছিল মানুষ। এলা নদীটা খোঁড়ার পর আমরা হাঁস পালি, মাছ ধরি, গরুক গোসল করাই। ফির কোনো কোনো এলাকাত মানুষও গোসল করে। এটা হামারগুলার জন্য ভালো হইচে।’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রেজওয়ানুল হক জানান, মরা তিস্তা দখলে থাকায় প্রতিবছর বন্যার পানি নিষ্কাশন হতে না পারায় জলাবদ্ধতা হতো। তিন উপজেলার নষ্ট হতো হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতির মুখে পড়তেন তারা। সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। তারা আশা করছেন আর জলাবদ্ধতা হবে না। মানুষ উপকৃত হবে।
রংপুর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ন প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে এই নদীগুলো ভরাট হয়ে গিয়েছিল। গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। অনেকেই চাষাবাদ করতেন। এতে জলাবদ্ধতা হতো, বন্যা হতো, ফসলের ব্যাপক ক্ষতিও হতো। জলাবদ্ধতায় থাকা জমিগুলো এখন চাষের উপযোগী হয়ে উঠছে।
তিনি আরও জানান, নদী ও বিল খননের ফলে এলাকাবাসীর দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক এখন পানির সুবিধা পাবেন।
তিনি বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে আমরা নদীর দুধারে গাছ লাগিয়েছি। এলাকার প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এলাকার বিনোদনের জায়গা হিসেবে বিলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’