ভরা মৌসুমেও জেলেরা নাগাল পাচ্ছে না ইলিশের। কালে ভদ্রে যা জালে উঠছে, তা দিয়ে নৌকার খরচের টাকাই তোলা দায় হয়ে পড়েছে। জেলেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন হতাশায় পরিণত হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
ইলিশের সংকট প্রভাব ফেলেছে দেশের অন্যতম বড় ইলিশের বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছ ঘাটেও। মাছ ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে এখন ফতুর হওয়ার পথে। বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে ৫ থেকে ৬ হাজার মণ ইলিশ আহরণ করলেও, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৫শ’ থকে ৬শ’ মণে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় ইলিশের দাম বেশ চড়া।
জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ অভিযান সফল না হওয়া, নদী দূষণ, নাব্যতা সংকট, অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদীর তলদেশে থাকা ডুবো চর ও ইলিশের গতি পথ বদলের কারণে স্থানীয় পদ্মা-মেঘনায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে বড়স্টেশন মাছ ঘাটে দেখা যায়, ক্রেতা বিক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। তবে বাজারে ইলিশের আমদানি অনেক কম। দুপুর দেড়টা নাগাদ বেশির ভাগ আড়তেই ইলিশের বিক্রি শেষ হয়ে গেছে।
পদ্মা-মেঘনায় মাছ না পাওয়ায় হতাশা বাড়ছে জেলেদের।ছবি : নিউজবাংলাচাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার জানান, কয়েক বছর আগেও পদ্মা-মেঘনা নদীতে জেলেরা প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পেত। কিন্তু দিন দিন এ চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। আগের মৌসুমে স্থানীয় নদীতে জেলেরা প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ’ মণ ইলিশ আহরণ করলেও বর্তমানে ২০-৩০ মণও হয় না। নদীতে ইলিশ না পাওয়ায় জেলেদের অনেক কষ্টে দিন কাটছে।
তবে দেড় থেকে দুই মাস পরে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শুরু হবে। এ সময় সরবরাহ বাড়লে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে। নয়তো ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়বে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, সাগর ও মোহনা অঞ্চলের ৫ থেকে ৬শ’ মণ মাছ এখন ঘাটে আসছে। এগুলোই ঢাকা, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নাটোর, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবে বরাত বলেন, মূলত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু এ বছর আগস্ট মাসের অর্ধেক সময় শেষ হয়ে গেলেও বাজারে মাছের সরবরাহ বাড়েনি। ফলে বাজারে ইলিশের দামও বেশি।
তিনি জানান, বর্তমানে ১ থেকে ১ কেজি ৪শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকায়। গত বছর যা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার টাকা কেজি দরে। ৭শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম কেজি প্রতি ১হাজার টাকায় বিক্রি হলেও গত বছর সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় ও ৪শ’ থেকে ৬শ’ গ্রাম ওজনের মাছ কেজি প্রতি ৭শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা কেজি দরে।
চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ কম থাকায় ইলিশের দাম চড়া। ছবি: নিউজবাংলামাছ ব্যবসায়ী শবে বরাত জানান, করোনাকালে মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা সংরক্ষণ অভিযানের সময় প্রশাসনের ব্যস্ততার সুযোগে অসাধু জেলেরা ব্যাপকহারে ইলিশ ও জাটকা নিধন করেছে। এ ছাড়া বছরজুড়ে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদী দূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হয়তো মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে জেলে বা ব্যবসায়ী কেউই টিকে থাকতে পারবে না এ পেশায়। জীবনধারনের জন্য তখন অন্য পেশা বেছে নিতে হবে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার হরিণা ফেরিঘাট এলাকার জেলে আলী আকবর বলেন, ‘মার্চ-এপ্রিল দুই মাস জাটকা অভিযানের শেষে ১ মে তনে গাঙ্গ ইলিশ দরতে নামচি। কিন্তু গাঙ্গ মাছ নাই। যেই মাছ পাই হেইডা দিয়া ঠিকমত নৌকার খরচই ওডে না। আমাগো বাচ্চাগো লইয়া কেমনে সংসার চালামু? মাছ না পায়া অনেকেই অহন রিক্সা চালায়, হকারি করে, দিন দিন জালের কাম করাই কটিন অইয়া যাইতাচে।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান জানান, পদ্মা-মেঘনা পানি দূষণের পাশাপাশি নদীতে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবো চর থাকায় ইলিশ চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ইলিশ নদীতে কম আসছে।
তবে আগস্টের শুরু থেকে সাগর ও উপকূলের জেলাগুলোতে ইলিশ পাওয়া শুরু করেছে জেলেরা। অচিরেই চাঁদপুরের জেলেরাও পর্যাপ্ত ইলিশ পাবেন।