বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইলিশের ভাণ্ডারে ইলিশ নেই কেন

  •    
  • ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০৮:৪২

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান লোকমান আলী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে ডুবোচর জেগেছে। নদ-নদীর পানিও কমছে। এতে মাছের জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত বরগুনার প্রধান তিন নদী বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা। তবে এবার ভরা মৌসুমেও এসব নদীতে দেখা মিলছে না ইলিশের। দিনের পর দিন জেলেরা জাল ফেলেও ফিরছেন শূন্য হাতে।

মৎস্য গবেষক, জেলে ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের প্রবেশপথে বাধা, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, পানিদূষণসহ নানা কারণে ইলিশের পরিভ্রমণের সময় ও স্থান পরিবর্তিত হয়েছে। এতে ভরা মৌসুমেও জালে ধরা দিচ্ছে না ইলিশ।

স্থানীয়রা জানান, বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা নদীতে বছরব্যাপী চলে জেলেদের ইলিশ শিকার। বরগুনার বাসিন্দাদের বড় একটি অংশেরই জীবন-জীবিকা চলে এই তিন নদীর ইলিশে।

উৎপত্তিস্থল ভিন্ন হলেও সর্পিল আঁকাবাঁকা প্রবহমান তিনটি নদীই মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। ফলে তিন নদীতে সারা বছরই ধরা পড়ে ইলিশ। বিশেষ করে মৌসুমের সময় এসব নদীতে ধরা পড়ে প্রচুর ইলিশ।

প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ায় সরকারের ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের ইকোফিশ প্রকল্প-২-এর আওতায় এরই মধ্যে এই তিনটি নদীর পানির গুণাগুণ এবং কী ধরনের খাবার রয়েছে, তা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইলিশের জীবনচক্র ও স্বাদের কারণও অনুসন্ধান করবেন তারা।

গবেষণা কর্মটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইকোফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও মাৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল ওহাব।

তিনি বলেন, ‘বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বর- এই তিন নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী আমরা মনে করি, এই তিনটি নদী দেশের ইলিশের আরও একটি ভাণ্ডার হতে পারে। এ কারণে আমরা এই তিন নদীকে ইলিশের অভয়াশ্রম করার প্রস্তাব দিয়েছি।’

গবেষকরা অভয়াশ্রম করার প্রস্তাব দিলেও ভরা মৌসুমেও এসব নদীতে মিলছে না রুপালি ইলিশ। বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী ও সাগরে হাজার হাজার জেলে প্রতিদিন জাল ফেললেও হতাশ হয়ে তীরে ফিরছেন।

জেলেরা জানান, তারা বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর নদীসহ গভীর বঙ্গোপসাগর ও সাগরের মোহনায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও নৌকা নিয়ে ইলিশের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। কিন্তু ইলিশের দেখা মিলছে না।

পাথরঘাটা উপজেলার ট্রলারমালিক দুলাল মিয়া জানান, জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু মৌসুমের প্রায় দুই মাস পার হলেও ইলিশ না পাওয়ায় তারা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।

স্থানীয় মাৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ টন ইলিশ আহরণ করা হয়। এর প্রায় ৬৬ ভাগ ধরা পড়ে বরিশাল বিভাগে।

ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে শুধু বরগুনা জেলা থেকে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৯৩৮ টন। এসব ইলিশের বেশির ভাগই ধরা হয় বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর ও পাথরঘাটা থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়।

তবে এ বছর মৌসুমের মাঝামাঝি সময় পার হলেও ইলিশের দেখা মিলছে না। জেলেরা বলছেন, ডিম ছাড়ার জন্য বছরের এ সময় ইলিশ ঝাঁক বেঁধে নদীতে প্রবেশ করে। ইলিশ সব সময় সোজা পথে চলাচল করে। বাধা পেলে এরা গতি পরিবর্তন করে।

উপকূলসংলগ্ন পয়েন্টগুলোতে ডুবোচরে বাধা পেয়ে নদীতে প্রবেশ করতে পারছে না ইলিশ। এ ছাড়া নদীতে পানি কম। জোয়ারে স্রোতও নেই। এসব কারণে ইলিশের ঝাঁক উজানের দিকে আসছে না। তাই ধরাও পড়ছে না।

বরগুনা সদর উপজেলার নলী চড়কগাছিয়া এলাকার আবদুর রশীদ সাগরে ইলিশ শিকার করছেন ৩০ বছর ধরে। তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরে অসংখ্য ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। ইলিশ বিচরণের সময় ডুবোচরে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে। এসব কারণে ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসছে না।

পাথরঘাটার কালমেঘা এলাকার জেলে সেন্টু মিয়া জানান, বছরের এই সময়ে বৃষ্টি হলেই নদীতে ইলিশ ধরা পড়ত। এবার প্রচুর বৃষ্টি হলেও নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না।

পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের বলেশ্বর তীরবর্তী এলাকার জেলে আলম মিয়া জানান, উজানের ঢলের কারণে জোয়ারের পানিতে স্রোত নেই। এতে জোয়ারের সময় নদীতে পানি কম থাকছে। এ কারণে ইলিশের ঝাঁক উজানের দিকে আসছে না। তাই ধরাও পড়ছে না।

বরগুনা উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরীর অভিযোগ, ডুবোচরের বাধা ছাড়াও নদীতে ইলিশের প্রবেশপথে ও সাগরমোহনার ডুবোচরে অসাধু জেলেরা বেহুন্দি, চরঘেরা, পিটানো, খরছি, জাম খরছি নামের অবৈধ জাল পাতছেন। এসব জাল অনেকটা বেড়ার মতো। এসব জালে বাধা পেয়ে ইলিশ সাগরে ফেরত যাচ্ছে।

তিনি জানান, এসব জাল যেখানে পাতা হয়, সেই স্থানে কিছুদিনের মধ্যেই চর পড়ে যায়। ডুবোচরের বাধা অপসারণ ও বিচরণস্থলে অবৈধ জাল পাতা বন্ধ না হলে ইলিশের আকাল দিন দিন প্রকট হয়ে উঠবে।

অবৈধ জালের বিষয়ে জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার কথা বললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান লোকমান আলী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে ডুবোচর জেগেছে। নদ-নদীর পানিও কমছে। এতে মাছের জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

ভরা মৌসুমে ইলিশ ধরা না পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির কলেজ অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক শহীদুল্লাহ মিয়া জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোনা ও স্বাদু পানিতে বিচরণ করা মাছের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন হয়। যার সঙ্গে মাছের প্রজননচক্র, মাছের দেশান্তর গতিবেগ, বাঁচা ও মরার হার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।

তিনি জানান, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে ইলিশের ঝাঁক মোহনার নিম্নাঞ্চলে স্থানান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এতে সাধারণ জেলেদের পক্ষে ইলিশ আহরণ নাগালের বাইরে চলে যাবে।

ইলিশের স্বাদু ও লোনাপানির বার্ষিক আহরণের তথ্য অনুযায়ীও ইলিশ আহরণ দিনে দিনে লোনাপানিতে বাড়ছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ইলিশের প্রজনন মোহনার নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে।

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার দেব জানান, উত্তরের ঢলের পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্য ও পলি নামছে। ভাটার সময় তীব্র বেগে পানি নামে। সেই তুলনায় জোয়ারের সময় সাগরে পানি উঠতে পারছে না, স্থির হয়ে আছে।

তিনি আরও জানান, এই বর্জ্যসহ দূষিত পানির কারণেও ইলিশ উঠছে না। এ ছাড়া অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে ইলিশ পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে কারণে এখন নদীতে ইলিশ মিলছে না।

এ বিভাগের আরো খবর