ঢাকার সাভারে অন্তঃসত্ত্বা নাতনিকে আনতে গিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে দুজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাদের মারধরের পর ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে মোবাইল ফোন ও টাকা। এখন মারধরের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ নির্যাতিতদের উদ্ধার করলেও প্রথমে তাদের অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়নি। পরে অবশ্য দুইজনকে আটক করেছে।
সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন সন্দেহভাজন দুজনকে উপজেলার বনগাঁও ইউনিয়নের সাদাপুর কাজীপাড়া এলাকা থেকে আটক করার বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন।
নির্যাতনের শিকার দুজন হলেন পঞ্চাশোর্ধ আবদুল মান্নান ও শহীদ মোল্লা। তারা দুজন সম্পর্কে আত্মীয়। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার ধরলা ইউনিয়নের বাসিন্দা তারা।
তাদেরকে নির্যাতনের অভিযোগে আটক হয়েছেন বনগাঁও ইউনিয়নের সাদাপুর কাজীপাড়া এলাকার গৃহবধূ সোনিয়া আক্তারের স্বামী আবুল কালাম ও শ্বশুর বাশার মহাজন।
১১ মাস আগে সোনিয়ার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কালামের।
আবদুল মান্নানের ছেলে ফরিদুল আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, সোনিয়ার বাবা ১০ বছর আগেই সৌদি আরবে মারা গেছেন। তারপর সে তার নানা আরশাদ আলীর বাড়িতে বড় হয়েছে।
১১ মাস আগে কালামের সঙ্গে যখন সোনিয়ার বিয়ের বিষয়ে কথা চলছিল, তখন কালামের পরিবারের সঙ্গে বিবাদ হয়েছিল বলেও জানান ফরিদুল। দুজনের বিয়ে হলেও মনোমালিন্য চলছিল। এ কারণে সোনিয়াদের বাসার কেউ কালামদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন না।
এরই মধ্যে সোনিয়া সন্তানসম্ভবা হওয়ার কথা জানতে পেরে তাকে মায়ের কাছে আনার কথা চলছিল। এ জন্যই গত মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে সোনিয়ার নানা আবদুল মান্নান ও তার ফুপাতো ভাইকে বনগাঁও পাঠানো হয়। তবে তারা সোনিয়ার শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে সাদাপুর বাজারে বসে স্থানীয় দুজনকে সোনিয়াদের বাড়িতে পাঠান। সোনিয়াকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসতে দেবে কি না সেটা জানার জন্যই এই কাজ করেন তারা।
ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘পরে সোনিয়ার স্বামী ও শ্বশুরসহসহ তাদের বাড়ির লোকজন বাজারে এসে আমার বয়স্ক বাবা ও তার ফুপাতো ভাইকে মিছমোড়া করে গামছা দিয়ে বাঁধেন। মারতে মারতে নির্জন স্থানের একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে নিয়ে বসিয়ে মোবাইল ফোন ও টাকা কেড়ে নেন।
‘সাদা কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেন। পরে নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও করে আমাদের কাছে পাঠান। ভিডিওতে ওদের পক্ষে জোর করে কথা বলিয়ে নেন তারা। ওই ভিডিও ও ছবি আমাদের এলাকার অনেকের কাছে পাঠিয়ে সামাজিকভাবে হেয় ও ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন।’
পরে ৯৯৯-এ ফোন করে বিষয়টি জানানো হলে মঙ্গলবার রাত তিনটার দিকে দুজনকে উদ্ধার করা হয় বলে জানান ফরিদ।
তিনি জানান, বুধবার বিকেলে অভিযোগ দিতে সাভার মডেল থানায় গেলে ডিউটি অফিসার পরামর্শ দেন এসআই নাজিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে। পরে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) কামাল হোসেন বিষয়টি জানালে তিনি বৃহস্পতিবার সকালে আবার থানায় ডাকেন।
তবে যাওয়ার আগে এসআই নাজিউরকে ফোন করলে তিনি বলেন বিকেলে আসতে। পরে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানানোর পর এসআই ফরিদ ও তার বাবা মান্নানকে ফোন করে ডাকেন। এরপর মান্নান লিখিত অভিযোগ করেন।
তবে সোনিয়ার স্বামী আবুল কালাম নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তো নির্যাতন করি নাইকা। ওনারা আমার আত্মীয় না। আমার শ্বশুরও না, নানাশ্বশুরও না। একজনরে তো আমি চিনিই না। আরেকজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়। দুইজন আসছেন। আইসা আমার বউরে জোরজবরদস্তি কইরা টাইনা নিয়া যাইতে চাইছে। তখন আমার বউ বাঁচাও বাঁচাও বইলা চিৎকার করছে। পরে দৌড়ায় গিয়া ধইরা আইনা বাইন্ধা রাখছে। পরে তো এখানে মীমাংসার মতো হইছে।’
কী কারণে আপনার স্ত্রীকে ওনারা জোর করে নিয়ে যাবেন- এমন প্রশ্নে অসংলগ্ন আবুল কালাম বলেন, ‘ওনাদের আমি জিজ্ঞেস করছি। তখন ওনারা কয়, বিয়া পড়াইছি ১০ লাখ টাকা কাবিন। এহন ওরে নিয়া মামলা দিমু, ১০ লাখ টাকা নিমু। এটাই হলো প্লান। ওনারা এটা বলছে আমারে।’
কালাম মোবাইল ও টাকা কেড়ে নেয়ার কথা অস্বীকার করলে সাদা কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নেয়ার কথা স্বীকার করেন। এর কারণ বলতে পারেননি তিনি।
নির্যাতনের ভিডিও ও ছবির বিষয়ে বলেন, ‘আমি নিজে ছবি, ভিডিও ওনাদের দিছি। ওনাদের চেনেন কি না সে জন্য দিছি।’
সোনিয়ার নানা আরশাদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার নাতনির বাচ্চা হইব দেইখা ওর মায়েরে কয়েক দিন আগে আনতে পাঠাইছিলাম। কিন্তু ওরা সোনিয়ারে আইতে দেয় নাই। পরে পরশু দিনকা আমরা শালা (মান্নান) ও পুতরারে (শহীদ) পাঠাইছিলাম সোনিয়ারে আনবার। কিন্তু ওগো বাইন্ধা মারধর করছে ওরা।’
সোনিয়ার মা আসমা আক্তার অভিযোগ করেন, ‘আমার মাইয়াডা সন্তানসম্ভবা। এই সময়ডায় মাইয়াগো মায়ের কাছে থাকন লাগে। কয়দিন আগে আনবার গেছিলাম আমি। কিন্তু আমরার সাথে জামাইয়ে (কালাম) খারাপ ব্যবহার করছে।
‘প্রথমে কথাও কয় নাই। পরে সোনিয়ার শাশুড়ি অনুরোধ কইরা দুই দিন আমারে ওই বাইত্তে রাখছিল। ১০ লাখ ট্যাকা চায় জামাই। অ্যারপর জামাইয়ে আমার কাছ থাইকা একটা সাদা কাগজ আর স্ট্যাম্পে সই নিছে। তারপরও মাইয়ারে আমার লগে আইতে দেয় নাই। অহন আমার মাইয়াডারে নিয়া আমি চিন্তায় আছি। আমার মাইয়ারে আমার কাছে ফিরায় দেন আপনেরা।’
বনগাঁও ভবানীপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) নাজিউর রহমান ফোন ধরে সব শোনার পরে বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি, পরে ফোন দেন।’
সাভার মডেল থানার ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তো এতকিছু জানি না। ওনাদের একটু থানায় পাঠায় দেন। আমরা মামলা নেব।’
তিনি বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত কালাম ও তার বাবাকে আটক করা হয়েছে।’
সাভার মডেল থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা নিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’