অনুমোদনহীন আইপি টিভি জয়যাত্রা টেলিভিশনে কাজ করার জন্য ২০১৯ সালের আগস্টে নিয়োগ পেয়েছিলেন ময়মনসিংহের রবিউল আওয়াল রবি। মাঝেমধ্যেই তাকে লাইভসহ উন্নয়নমূলক প্রতিবেদন করতে বলা হতো।
এ জন্য অগ্রিম কিংবা প্রতিবেদনের পর দিতে হতো ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এতদিন এসব তথ্য গোপন রাখলেও এবার হেলেনা জাহাঙ্গীরের ‘গোপন বাণিজ্য’ নিউজবাংলার কাছে ফাঁস করে দিলেন তিনি। এ ছাড়া জয়যাত্রার ফেসবুক গ্রুপসহ অন্যান্য ফেসবুক মেসেঞ্জারে টাকা লেনদেনের প্রমাণ নিউজবাংলার হাতে এসেছে।
সেখানে দেখা যায়, ‘দেশ জয়যাত্রা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে সারা দেশে জয়যাত্রা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের টাকা লেনদেনের জন্য সুনির্দিষ্ট মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
জরুরি বিজ্ঞপ্তি: জয়যাত্রা টিভির সব প্রতিনিধিদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র ০১৯৫৮৩১৫০০২ নম্বর ছাড়া অন্য কোনো নম্বরে লেনদেন করলে অফিস কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। দুর্নীতি করে কেউ ধরা পড়লে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রিয় প্রতিনিধিবৃন্দ, আপনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের জয়যাত্রা টেলিভিশন। দু’চারজন কুচক্রীর কারণে কোনোভাবেই জয়যাত্রার সুনাম নষ্ট হতে দেয়া হবে না। ঈদের পরই জয়যাত্রা নতুন রূপে দর্শকের সামনে আবির্ভূত হবে। আপনাদের সুস্থতা কামনা করছি। সিও।
গত ২১ অক্টোবর জয়যাত্রা অফিসে কর্মরত একজন লিখেছেন- প্রিয় প্রতিনিধিবৃন্দ শুভেচ্ছা জানবেন। এখন পর্যন্ত যারা যারা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ফি জমা দেননি দ্রুত সময়ের মধ্যে ০১৯৫৮৩১৫০০২ নম্বরে পেমেন্ট করার জন্য অনুরোধ কারা হলো...কর্তৃপক্ষ।
এই কথার উত্তরে মফস্বলে কর্মরত জয়যাত্রা টিভির একজন সাংবাদিক লেখেন, এটা কিসের ফি বুঝলাম না ভাই।
আরেক লেখায় দেখা যায়, অফিস থেকে কমার্শিয়াল নিউজ করতে বলা হচ্ছে। এ জন্য প্রতিনিধিদের কাছে কৌশলে টাকা চাওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর জয়যাত্রা অফিসে কর্মরত আরেকজন লিখেছেন- জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রতিনিধিদের আগের নির্দেশনা মোতাবেক জানানো যাচ্ছে যে, জানুয়ারি মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে প্রত্যেকে ৩ হাজার টাকা করে অফিসের বিকাশ পেমেন্ট নম্বরে পাঠাবেন এবং আমাকে জানাবেন।
এখানে আরও বলা হয়, যদি কোনো প্রতিনিধি টাকা পাঠাতে ব্যর্থ হন তাহলে নিজ নিজ উদ্যোগে আইডি কার্ড ও নিয়োগপত্র অফিসে জমা দিয়ে পাওনাদি নিয়ে যাবেন। দুঃসময়ে আপনার সহযোগিতাই অফিস কর্তৃপক্ষের একমাত্র কাম্য।
এভাবে টাকা লেনদেনের বিষয়ে জয়যাত্রা টিভির সাবেক ময়মনসিংহের সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবির সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।
তিনি বলেন, ‘জয়যাত্রা নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশন পর্দায় আসবে এমন তথ্য পাই। এরপর ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জয়যাত্রা টিভির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি৷ তিনি সরাসরি অফিসে এসে হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তখন তার কথামতো আমি অফিসে চলে যাই।’
রবিউল বলেন, ‘অফিসে যাওয়া পর আমি আগে কোথায় কাজ করেছি এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলে নিয়োগপত্র দেন। তবে নিয়োগ দেয়ার আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর কয়েকটি শর্ত দিয়ে বলেন, আমরা তো সামনে সরকারি অনুমোদন নিয়ে স্যাটেলাইটে চলে আসব। এখন তো ময়মনসিংহে এই টিভি দেখা যাচ্ছে না। এ জন্য ক্যাবলে লাইন দিতে হবে। এটি আপনাদেরকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
রবিউল বলেন, ‘নিয়োগের পরপরই আমাকে বলা হয় তাদের অফিসে কর্মরতদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হেলেনা। এ সংকট সব প্রতিনিধিকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য কয়েক মাস ২ হাজার টাকা করে তাদের বিকাশ নম্বরে পাঠাতে বলেন। তখন আমিসহ সব প্রতিনিধি ২ থেকে ৩ হাজার করে টাকা পাঠাতে শুরু করি। কয়েক মাস এভাবে টাকা পাঠানোর পর আবারও বেশি টাকা পাঠাতে বলা হয়। ব্যুরো চিফ প্রতি মাসে ৩ হাজার, জেলা প্রতিনিধি ২ হাজার ও উপজেলা প্রতিনিধি ১ হাজার টাকা বাধ্যতামূলক দিতে হবে। তখন সবাই টাকা দিতে থাকেন।
‘আমাকে কয়েক মাস আগে বলা হয়েছিল আইডি কার্ডের মেয়াদ চলে গেছে। সে ক্ষেত্রে তারা নতুন আইডি কার্ড দেবে এবং আমাকে এ জন্য ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। জয়যাত্রা টিভিতে ভেঙে ভেঙে টাকা নেয়াসহ ব্যুরো অফিস ও ক্যামেরা দেয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। কয়েক মাস আগে তাদের ফাঁদ বুঝতে পেরে নিজ থেকেই এই আইপি টিভি থেকে সরে এসেছি।’
অফিস থেকে বেতন দেয়নি, তারা বললেই আপনারা টাকা পাঠাতেন কেন? এমন প্রশ্নে রবিউল বলেন, ‘আসলে সব সময় আমাদের হেলেনা জাহাঙ্গীর আশ্বাস দিয়ে বলতেন স্যাটেলাইট হয়ে গেলেই আমাদের ভালো বেতন দেয়া হবে। এমন আশ্বাস বুঝতে না পেরে ধাপে ধাপে প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জয়যাত্রা টেলিভিশনের নামে দেশ-বিদেশে অগণিত সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। আমরা মফস্বলে জয়যাত্রাতে যারা কাজ করেছি সবার সঙ্গেই প্রতারণা করা হয়েছে। আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরের এসব প্রতারণার ফাঁদ কেউ না বললেও এখন তা পরিষ্কার। আমাদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করার কারণে হেলেনার উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাই।’
আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে মিল রেখে নামসর্বস্ব সংগঠন ‘চাকরিজীবী লীগ’ নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। তিনি এই সংগঠনকে সামনে নিয়ে আসার পর ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন।
এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের পদ হারান হেলেনা। ক্ষমতাসীন দলের মহিলাবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্যপদ ছাড়াও কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। ওই ঘটনায় পিছুটান দেন হেলেনা। বলেন, তিনি ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে এই সংগঠনের কেউ না। তাকে সম্প্রতি সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
গত বৃহস্পতিবার তার গুলশানের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব-১-এর একটি দল। অভিযানে জব্দ করা হয় ১৯ বোতল বিদেশি মদ, একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, একটি হরিণের চামড়া, দুটি মোবাইল ফোন, ১৯টি চেকবই ও বিদেশি মুদ্রা, দুটি ওয়াকিটকি সেট এবং জুয়া (ক্যাসিনো) খেলার ৪৫৬টি চিপস।
পরে মধ্যরাতে তার জয়যাত্রা টেলিভিশনেও অভিযান পরিচালনা করা হয়। শুক্রবার রাতে তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং পল্লবী থানায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়।
এর মধ্যে গুলশান থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটিতে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে এই মামলায় তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
হেলেনার মালিকানাধীন জয়যাত্রা টিভিতে ভোলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নামে আব্দুর রহমান তুহিনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য সোমবার বিকেলে পল্লবী থানায় মামলা করেন আব্দুর রহমান।
এই মামলায় হেলেনার পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে জয়যাত্রা টিভির জেনারেল ম্যানেজার হাজেরা, প্রধান বার্তা সম্পাদক কামরুজ্জামান আরিফসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে।
রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে সোমবার রাতে হাজেরা খাতুন ও সানাউল্ল্যাহ নূরী নামে হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় সাত দিন এবং চাঁদাবাজি মামলায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে দুই মামলায় চার দিন করে মোট আট দিনের রিমান্ড দেন বিচারক।