করোনা মহামারিতে টিকার নিবন্ধন করতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কম্পিউটারের একটি দোকানে গিয়েছিলেন ঝিনাইদহের আনোয়ার হোসেন। সেখানে নিবন্ধন করতে না পারায় যান আরও কয়েকটি দোকানে।
সব জায়গা থেকেই তাকে জানানো হয়, টিকা নেয়ার ন্যূনতম বয়সসীমা পার হলেও তার নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। এতে সন্দেহ হয় আনোয়ারের।
সমাধান খুঁজতে জেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে তো ‘চক্ষু চড়কগাছ’। জানতে পারেন, নির্বাচন কমিশনের হিসাবে গত ৩ বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। এ কারণে হচ্ছে না টিকার নিবন্ধন।
এরপর থেকে নিজেকে জীবিত করতে আনোয়ারকে এখন ঘুরতে হচ্ছে জেলা নির্বাচন অফিসসহ নানা স্থানে।
আনোয়ার হোসেনের বাড়ি ঝিনাইদহ পৌরসভার কাঞ্চননগর গ্রামে। ১৯৬৮ সালের ৪ জানুয়ারি কাঞ্চননগরেই জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে সেখানেই নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন পেশায় ঠিকাদার আনোয়ার।
আনোয়ার জানান, তার ডায়াবেটিস, প্রেসারসহ নানা রোগ রয়েছে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় টিকার নিবন্ধন করতে গিয়ে ধরা পড়ে নির্বাচন কমিশনের হিসাবে তিনি মৃত। এরপর নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে ঘুরতে হচ্ছে নির্বাচন কার্যালয়, কাউন্সিলরের অফিসসহ নানা স্থানে।
জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে আনোয়ার। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘আমি গত ৬-৭ দিন আগে করোনার টিকা নেয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে যাই। ভোটার আইডি কার্ডটা নিয়ে কম্পিউটারের দোকানে গেলে উনারা বলেন, আপনার রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না।
‘কয়েকটা দোকান ঘুরে যখন দেখি একই অবস্থা, তখন তো আমি চিন্তায় পড়ে যায়। পরে নির্বাচন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, আমার তিন বছর আগে মৃত্যু হয়েছে।’
তার দাবি, সংশ্লিষ্টরা যেন তার জাতীয় পরিচয়পত্র দ্রুত সংশোধন করে দেয়।
আনোয়ারের মেয়ে আতিকা তাবাচ্ছুম বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ। এখন যদি তাকে নিয়ে দেশের বাইরে যেতে চাই তাহলে তো যেতে পারব না।
‘অন্য কাজকর্মও এর কারণে বন্ধ রয়েছে। ভোটার আইডি কার্ডের এই ভুল সংশোধন করতে এখন বারবার নির্বাচন অফিস, কাউন্সিলরের অফিসে যেতে হচ্ছে। অযথা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমাদের।’
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘আনোয়ার সাহেবকে নির্বাচন কমিশনের সাইটে মৃত দেখাচ্ছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে, তা যাচাই শেষে পাঠানো হবে নির্বাচন কমিশনে।’
তবে কী কারণে এমন ঘটনা তার সঠিক জবাব দিতে পারেননি তিনি।
সমস্যা জেলায় জেলায়
আনোয়ারের ক্ষেত্রে হওয়া এ সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন জেলায় জীবিতদের ‘মৃত’ দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নেত্রকোণার মদন পৌরসভার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের আব্দুল আওয়াল উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যে মৃত ছিলেন ৯ বছর। আউয়াল ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রতিনিধি। নির্বাচন অফিসের তথ্যে তার মৃত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
৯ বছর ধরে নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়া এই গণমাধ্যমকর্মীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই ভুল সংশোধন হয়ে যায়। এপ্রিলের শেষে মৃতের তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
লালমনিরহাটে এক স্কুলশিক্ষকসহ অন্তত ১৯ জন জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়।
তাদের একজন হলেন আদিতমারী উপজেলার বালাপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লক্ষ্মী কান্ত রায়।
তিনি সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ করেন।
তালিকায় মৃত থাকায় গত মার্চে করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছিলেন না এই শিক্ষক। তবে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তাদের আইডি আবার সচল হয়।
সংখ্যাটি কয়েক লাখ
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭১ জন মৃত ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পরবর্তী সময়ে নিজেদের জীবিত বলে দাবি করেন।
এ রকম জীবন্মৃত কয়েক লাখ মানুষের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো সহজ সমাধান নেই।
প্রতিবছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করলেও সেই ভুতুড়ে বিষয় দূর হচ্ছে না। এখনও প্রতিবছর অনেক জীবিত ব্যক্তি ভোটার তালিকায় ‘মারা পড়ছেন’।
নির্বাচন কমিশন এখন দায় চাপাচ্ছে তথ্য সংগ্রহকারী আর আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া করা ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ওপর।
প্রভাব ব্যাপক
ভোটার তালিকায় মৃত হিসেবে চিহ্নিত হলে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্লক হয়ে যায়। ফলে এখন এমন কারও পক্ষে মোবাইল সিম কেনা, ব্যাংক হিসাব খোলা, পাসপোর্টের আবেদন, বিদেশ যাত্রা, টিকার নিবন্ধন, চাকরিতে আবেদনসহ সরকারি অনেক সেবাই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এমনকি ব্যবসা করতে ট্রেড লাইসেন্সও করা যাবে না।
বহু মানুষ বয়স্ক, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাও পাচ্ছেন না তালিকায় মৃত থাকায়। যাদের এই সমস্যা আছে এবং এতদিন যারা ভাতা পেতেন হাতে হাতে, তাদের ভাতাও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা যাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সরাসরি। কিন্তু তারা কেউ সিম কিনতে পারবেন না, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাও চালু করতে পারবেন না।