বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পাহাড় কাটার কারণেই ধস

  •    
  • ২৮ জুলাই, ২০২১ ২২:১১

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, পাহাড়ে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। টাকার বিনিময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ পাহাড়ে থাকছেন। আর স্থানীয় প্রভাবশালীরা নির্বিচারে পাহাড় কাটছেন। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।

‘আমরা অল্প আয়ের মানুষ। যা আয় করি তা দিয়ে দুই বেলা ভাত জোটাতে কষ্ট হয়। ভাড়া কম বলে এখানে থাহি। জীবনের রিস্ক আছে, তবুও তাহি। সরকার তো আমগোরে পুনর্বাসন করছে না। যদি করত তাহলে এখান থেইকা যাইতামগা।’

কথাগুলো চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোড পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা সুরাইয়া বেগমের। এক যুগ ধরে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি পাহাড়ে বসবাস করছেন।

টানা কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রামে বৃষ্টি হচ্ছে। কখন পাহাড় ধসে যায়, অথবা কখন প্রশাসন এসে তাদের তুলে দেয়, সে কারণে সুরাইয়ার চোখে ঘুম নেই।

‘স্থানীয় এক নেতাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পাহাড়ে বসবাস শুরু করি। প্রশাসন দুইবার উচ্ছেদ করেছে। কিন্তু আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তাই আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে।’ বলেন সুরাইয়ার প্রতিবেশী রিকশাচালক আবদুল মালেক।

সুরাইয়া ও মালেকের মতো হাজার হাজার স্বল্প আয়ের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন পাহাড়ের পাদদেশে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পাহাড়ে বসবাসকারীর সংখ্যা। সঙ্গে বাড়ছে অবৈধ পাহাড় দখলদারও। আর দখলের পর কাটা হচ্ছে পাহাড়। তাতে দীর্ঘ হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা। মূলত এভাবেই চলছে চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষার কাজ।

মঙ্গল ও বুধবার কক্সবাজারে পাহাড়ধসে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরপর থেকে চট্টগ্রামেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। বুধবার শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

তবে শুধু বর্ষাকেন্দ্রিক এসব তৎপরতায় চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪। এসব পাহাড়ে বসবাসকারীর মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজারের অধিক। তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ পাহাড়ে বসবাস করছেন বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, পাহাড়ে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। টাকার বিনিময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ পাহাড়ে থাকছেন। আর স্থানীয় প্রভাবশালীরা নির্বিচারে পাহাড় কাটছেন। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।

২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন।

বাংলাদেশে পাহাড়ধসে প্রাণহানিকে আর্থসামাজিক, পরিবেশগত এবং রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসাইন। আর মূলত পাহাড়খেকোদের কারণে পাহাড়ধস হচ্ছে বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাহাড়গুলো বালুময়। এসব পাহাড়ে অনেক ফাটল থাকায় অতিবৃষ্টির ফলে প্রাকৃতিকভাবেই পানি ঢুকে ধস হতে পারে। তবে এ সমস্যার কারণে পাহাড়ধস ঘটে কম। সবচেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট কারণে পাহাড় ধসে।

অধ্যাপক হোসাইন বলেন, চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোডটি তৈরির করার সময় অন্তত ১৫টি পাহাড় কাটা হয়েছে, সব পাহাড় কাটা হয়েছে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে; যা অত্যন্ত অমানবিক। প্রকৃতির সঙ্গে একধরনের শত্রুতা করা হয়েছে। একই কাজ করা হচ্ছে বসতি স্থাপনে। ফলে বর্ষা এলেই পাহাড়গুলো ধসে পড়ছে।

তিনি বলেন, ব্যাপক হারে গাছ কাটার ফলে পার্বত্য এলাকার পাহাড়গুলো ন্যাড়া চেহারা নিয়েছে৷ পাহাড়ের বড় গাছের শিকড় যেমন গভীরে গিয়ে মাটিকে আঁকড়ে থাকে; তেমনি গাছ কেটে ফেলার কারণে মাটির শক্তি কমে যাচ্ছে৷ পাহাড়ধসের এটাও বড় একটি কারণ৷

পাহাড়ধসের ঘটনার পর উচ্ছেদসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমনটা এখন চলছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলছে প্রায় প্রতিবছর। একদিকে পাহাড় কেটে চলছে বসতি নির্মাণ এবং অপরদিকে পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু।

অন্যদিকে বর্ষা এলে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারা আবারও এসে বসতি স্থাপন করেন। ফলে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো থেকে মানুষকে স্থায়ীভাবে সরানো যায় না।

অধ্যাপক কামাল হোসাইনের মতে, তাদের পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে না পারার কারণটি আর্থসামাজিক।

কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় ছিন্নমূল এসব মানুষ কম খরচে এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাতেই বসবাস করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে এ ঘরগুলো তৈরি করছেন। এটার সঙ্গে আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা জড়িত, সে জন্য চাইলেও তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না।

পাহাড়গুলো দিন দিন নিধন হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের পাহাড় রক্ষা করবে কে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্জন যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতা। পাহাড়গুলো রক্ষা করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতার মধ্যে একটি।

‘বাংলাদেশে তেমন পাহাড় নেই। শুধু চট্টগ্রাম রিজিয়নে (অঞ্চলে) পাহাড় রয়েছে। সিলেটেরগুলোকে আমরা পাহাড় বলতে পারি না, সেগুলো টিলা। ফলে শুধু চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা করতে এত বেশি কিছুর দরকার নেই। কার্যকর একটি পাহাড় রক্ষা কমিটি গড়ে দিলে পাশাপাশি কমিটিকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে এলে পাহাড়গুলো রক্ষা করা সম্ভব। এখন পাহাড় রক্ষা কমিটি আছে, তবে তারা কাজের কাজ কিছুই করছে না।’

শুধু উচ্ছেদ করে পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের কারণ হচ্ছে মানুষের জানমাল রক্ষা করা।

‘পাহাড়ে যারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ছেন তারা কিন্তু ফ্রিতে সেখানে থাকছেন না। নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে টাকা দিচ্ছেন। বসতি স্থাপনা বন্ধে এর পেছনের লোকগুলোকে ধরতে হবে। পাশাপাশি যারা পাহাড়ে বসবাস করছেন, তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন করতে হবে। নয়তো পাহাড়ে বসতি স্থাপন বন্ধ সম্ভব নয়। আর বসতি স্থাপন বন্ধ না হলে পাহাড় সব নিধন হয়ে যাবে।’

তবে তিনি আশাবাদী, কারণ পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি পাহাড় রক্ষা এবং ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে কাজ করছে। মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। যার মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও আছে।’

এ বিভাগের আরো খবর