রাত ১২টা পেরিয়েছে। সিলেট নগরীর রিকাবীবাজার এলাকায় চলছে সড়কের সংস্কারকাজ।
দেখে মনে হতে পারে, সংস্কারকাজ করাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তবে কাছে গেলে ভুল ভাঙে।
সড়কের সংস্কারে ব্যস্ত এক নারী। তবে পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে, নির্মাণশ্রমিক নন তিনি।
যে সড়কে সংস্কারকাজ চলছে তার পাশেই শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিলেটের একমাত্র ডেডিকেডেট চিকিৎসাকেন্দ্র এটি।
ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় হাসপাতালে বেড়েছে রোগী চাপ। এখন রাত-বিরাতেও অ্যাম্বুলেন্স যাওয়া-আসা করে এখানে।
অথচ হাসপাতালটির একটু সামনের এ সড়কে তৈরি হয়েছে বিরাট গর্ত। রিকাবীবাজার এলাকার মাদার কেয়ার ক্লিনিকের পাশে একটি সেতুর মুখে সড়কের পিচ উঠে গর্ত ও খানাখন্দের তৈরি হয়েছে। ফলে সেতুতে ওঠানামার সময় বিরাট ধাক্কা খায় রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ সব গাড়ি।
এ সড়ক দিয়ে একটু এগোলেই সিলেটের সর্ববৃহৎ চিকিৎসাকেন্দ্র এমএজি ওসমানী হাসপাতাল। হাসপাতালের রোগীদেরও একটি বড় অংশ ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন। ফলে ভাঙা সড়কের কারণে তাদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি ভাঙাচোরা থাকলেও তা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। এতে আরও দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষজনের।
রোগীসহ সাধারণ যাত্রীদের এই দুর্ভোগ দেখে নিজেই সড়ক সংস্কারে এগিয়ে এসেছেন এই নারী। তার নাম ফারমিস আক্তার।
নিজ উদ্যোগে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সড়কের খানাখন্দে সংস্কারকাজ শুরু করেন ফারমিস। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় সেতুর পাশের গর্তগুলো ভরাটে সক্ষম হন তিনি।
রাতে ফারমিসের সংস্কারকাজের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তার এই উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসা পায়। ফেসবুক ভিডিওতে মন্তব্য করে অনেকেই সাধুবাদ জানান তাকে।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, নির্মাণশ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে সংস্কারকাজে নেমে পড়েছেন ফারমিস। সড়কে ভাঙা স্থানে বালু, পাথর ও সিমেন্টের মিশ্রণ ফেলে তা পালিশ করার কাজ করছেন তিনি।
সড়ক সংস্কারের জন্য পাথর, বালু ও সিমেন্ট নিজ খরচেই সংগ্রহ করেছেন বলে জানান তিনি।
ফারমিস সিলেট নগরের পুলিশ লাইনস এলাকার বাসিন্দা। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সিলেটে সুপরিচিত। করোনাকালে সংকটে পড়া মানুষজনকে বিনা মূল্যে খাদ্যসহায়তা করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান তিনি।
চলমান শাটডাউনেও বিপাকে পড়া মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেন ফারমিস।
এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রাতে বিভিন্নজনের বাসায় খাদ্যসহায়তা নিয়ে যাই। যাওয়া-আসার সময় এই সড়কে খানাখন্দ ও গর্ত দেখতে পাই। এই সড়কের পাশেই শামসুদ্দিন হাসপাতাল; আর একটু সামনে ওসমানী হাসপাতাল।
‘প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ও লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। এখানে এসেই বিরাট ঝাঁকুনি খায় গাড়িগুলো। ফলে রোগীদের অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই এ রকম দেখছি। কিন্তু কেউ ভাঙা সড়কটি সংস্কার করছে না। তাই আজ রাতে নিজেই সংস্কারকাজে নেমে পড়েছি।’
নির্মাণসামগ্রী কীভাবে সংগ্রহ করেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারমিস বলেন, ‘নিজ খরচেই আমি বালু, পাথর ও সিমেন্ট সংগ্রহ করেছি। লকডাউনের কারণে এসব সংগ্রহে বেশ কষ্ট হয়েছে। সারা দিন খুঁজেও না পেয়ে শেষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সিমেন্ট সংগ্রহ করতে পেরেছি।’
স্বামী উপস্থিত থেকে তার কাজে সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে ফারমিস বলেন, ‘তিনি আমার সকল উদ্যোগেই সহযোগিতা করেন। খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতেও তিনি সহায়তা করছেন।‘অনেকে হয়তো রাতে রাস্তায় এসে আমার এই কাজের সমালোচনা করবেন। কিন্তু আমি এসব পরোয়া করি না। কিছু লোক থাকেই যারা সকল কাজের বিশেষত, মেয়েদের যেকোনো কাজেরই সমালোচনা করে।’এ সড়কের পার্শ্ববর্তী মাদার কেয়ার ক্লিনিকের কর্মী আশরাফ হোসেন বলেন, ‘সেতুর মুখে ভাঙা থাকার এখানে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় রিকশা ও মোটরসাইকেল উল্টে যায়।’ফারমিস আক্তারের সড়ক সংস্কারের এই ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেন, ‘আমাদের মেয়র মহোদয় ঘুমে, মধ্যরাতে রাস্তা সারাচ্ছেন ফারমিস আপা।’
ভাঙা সড়ক প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘সিলেটের সকল সড়কই সংস্কার করা হচ্ছে। অনেকগুলোর কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
‘তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির কারণে কোনো কোনো সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হতে পারে। আমরা সবগুলোই সংস্কার করছি।’