৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে নদীতে নৌকা নিয়ে মাছ শিকারে নেমেছিলেন জেলেরা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মেলেনি।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণে অনেক জেলেই মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ঋণগ্রস্ত। আর এখন নদীতে ইলিশ মিলছে না। এখনকার পরিস্থিতিতে জেলেরা বলছেন, এই সময়ে নদনদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় তারা চরম হতাশ।
নদীবেষ্টিত বরগুনা জেলার নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস মাছ ধরা।বরগুনার তিনটি প্রধান নদনদী বিশখালী, বলেশ্বর ও পায়রাকে ঘিরে হাজার হাজার প্রান্তিক জেলের বসবাস। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের মোহনায়ও ছোট নৌকা নিয়ে ইলিশ ধরেন কয়েক হাজার জেলে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, বরগুনা জেলায় প্রায় ৪৩ হাজার জেলে রয়েছেন যাদের জীবিকার একমাত্র উৎস্য নদীতে মাছ ধরা। টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া এই জেলেদের উপায় থাকে না। আর এই সময়টাতে পরিবার নিয়ে চলতে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিতে হয় তাদের।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের জেলে সিদ্দিক আকন। ছোট নৌকায় মোট চারজন জেলে মাছ শিকার করেন।
ইলিশ ধরতে নদীতে নামার অপেক্ষায় প্রস্তুত নৌকাগুলো। ছবি: নিউজবাংলা
সিদ্দিক বলেন, ‘হাঙ্গা বচ্ছর বইয়া রইছি সিজনে ইলিশ ধরমু। কিন্তু সিজনের শুরুতে টানা ৬৫ দিন মাছ ধরায় নিষেধ থাকে। মাছ আর ধরন যায় না। নিষেধাজ্ঞা শ্যাষ অইছে এহন নদীতে খ্যাও দিয়া মাছ পাইতে আছি না। মোগো গুরাগারা লইয়া খামু কী আর দাদনের টাহাই বা কেমনে দিমু।’
সিদ্দিকের মতোই বিশখালী তীরবর্তী এই গ্রামে আরও অনেক জেলের একই অবস্থা। পাথরঘাটার বলেশ্বর তীরবর্তী পদ্মা গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের আয়ের মূল উৎস মাছ শিকার। পেশাজীবী এসব জেলের দুর্দিন এখন চরমে।
এই গ্রামের জেলে আবদুল খালেকের বয়স এখন ৬৫ বছর। গোটা জীবনই নদীতে, সাগরে তিনি মাছ শিকার করেছেন। খালেকের তিন ছেলেও জেলে।
আবদুল খালেক বলেন, ‘ঋণে জর্জরিত মোরা, এহন সিজনে মাছ পাই না গাঙ্গে, কী দিয়া দাদন দিমু আর নিজেরাইবা কী খামু কন। কয়দিন পর আবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু অইবে, হেরপর সিজন শ্যাষ, মোগো কী উপায় অইবে।’
তালতলীর নিশানবাড়িয়া এলাকার জেলে রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘পরপর চার দিন খ্যাও দিছি, ছোট জাটকা সাইজের তিন-চাইরডা ইলিশ ওডে খ্যাওতে। চাইরজন মাইনসের একটা নাওতে তিনডা জাটকা ইলিশ পাইলে নিজেরাই বা খামু কী আর দাদনই বা দিমু কিইদ্দা কন।’
পায়রা পাড়ের গ্রামের বরগুনার বুড়িরচর ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার জেলে বাবুল বলেন, ‘পায়রায়ও ইলিশ নাই, গোনে (জোয়ারের পর) খ্যাও দি, ভাটিতে জাল টানি, ইলিশের দেহা নাই।’
ঠিক একই রকম অবস্থা বরগুনাসহ গোটা উপকূলের প্রান্তিক জেলেদের। উপকূলীয় জেলেদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ডোক্যাপ’র (DOCAP) হিসাবে উপকূলজুড়ে প্রায় এক লাখ প্রান্তিক জেলের বসবাস। যারা মূলত ছোট নৌকায় নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
খুদে এই জেলেদের নদীকেন্দ্রিক মাছ শিকারই একমাত্র জীবিকার মাধ্যম। ডোক্যাপের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলম বলেন, ‘প্রান্তিক জেলেদের প্রত্যেকেই দাদন নিয়ে নৌকা, জাল করে থাকেন। এ ছাড়া অলস সময়ে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দাদন হিসেবে ঋণ নেন। মৌসুমের একটা বিরাট সময়জুড়েই নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকতে হয় জেলেদের। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা সাগরের জন্য হলেও এই জেলেদেরও এখন আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর থেকে এরপর আবার প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। সব মিলিয়ে এখন ইলিশ শিকারের মৌসুম এদের। কিন্তু ইলিশ নদীতে ধরা না পড়লে এই জেলেদের কোনো উপায় থাকে না।’বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার দেব বলেন, মৌসুমে সাগর থেকে ইলিশ নদনদীতে বিচরণ করতে আসে। এ সময় প্রায় সবখানেই এসব ইলিশ ধরা পড়ে। আমরা আশা করি, শিগগিরই নদীতে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করবে।’
‘এবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলার প্রায় ৪০ হাজার জেলে পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে।’