বরগুনা বেতাগীতে সাবেক ইউপি সদস্য আনারুল ইসলাম টিটু হাওলাদারকে পিটিয়ে হত্যার চার দিন পর মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, তার স্ত্রী ও ভাইসহ ৩৮ জনকে।
নিহত আনারুলের স্ত্রী শিল্পী বেগম শুক্রবার সন্ধ্যায় বেতাগী থানায় এই মামলা করেছেন।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ৩৮ জনের নাম আসামি হিসেবে দেয়া হয়েছে মামলায়। অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ওসি বলেন, প্রধান আসামি করা হয়েছে বেতাগীর সরিষামুড়ি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ইমাম হাসান শিপনের ছোটভাই টিটু জোমাদ্দারকে। চেয়াম্যান শিপন ও তার স্ত্রী রিক্তা বেগম মামলার ২১ ও ২৪ নম্বর আসামি।
এই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য টিটুকে গত সোমবার (১৯ জুলাই) কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেতাগী-বরগুনা সার্কেল) মেহেদী হাসান বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে এজাহার নামীয় আসামি ফয়সাল বিশ্বাস, মো. আনিস ও আব্দুল মজিদ মোল্লা নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ওসি কাজী সাখাওয়াত বলেন, হত্যা মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, ইউপি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জেরে আসামিদের সঙ্গে টিটুর দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
টিটুর বাড়ি উপজেলার সরিষামুড়ি ইউনিয়নের ভোড়া এলাকায়। তিনি ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য।
তার স্বজনদের অভিযোগ, সরিষামুড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইউসুফ শরীফ ও বর্তমান চেয়ারম্যান ইমাম হাসান শিপনের মধ্যে ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিরোধের জেরে হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনা ঘটে। সেই সংঘর্ষের জেরেই এই হত্যার ঘটনা। টিটু সাবেক চেয়ারম্যান ইউসুফ শরীফের ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বায়েজিদ হোসেন (টিটুর ভাইয়ের ছেলে) বলেছেন, সোমবার সকাল ১০টার দিকে টিটু বেতাগীতে ইউপি সদস্যের সম্মানী ভাতার টাকা আনতে যান। দুপুর ১২টার দিকে বেতাগী সদর থেকে বাইকে করে সরিষামুড়ি ফিরছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি কাজিরাবাদ ইউনিয়নের কাউনিয়া পোলেরহাট ইটভাটা এলাকায় পৌঁছলে ১৫-২০ জন পথরোধ করে মারধর শুরু করে। হামলা থেকে বাঁচতে তিনি সড়কের পাশে খালে লাফ দেন।
খাল থেকে তুলে তার ঘাড়ের পেছনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেয়া হয় এবং ইট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়। এ সময় টিটুর সঙ্গে থাকা কয়েকজন তাকে বাঁচাতে চাইলে দুর্বৃত্তরা তাদের দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখায়। পরে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কালো মাইক্রোবাসে টিটুকে তুলে নিয়ে বরগুনার দিকে চলে যায়।
হামলাকারী কয়েকজনকে মোরটসাইকেলে ওই মাইক্রোর পেছন পেছন যেতে দেখা যায়।
কালো মাইক্রোতে বর্তমান চেয়ারম্যান ইমাম হাসান শিপনের ছোট ভাই রেজাউল ইসলাম ছিলেন বলে অভিযোগ করেন বায়েজিদ।
বেলা আড়াইটার দিকে বরগুনা-বাকেরগঞ্জ-বরিশাল সড়কের ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের ছোট গৌরীচন্না এলাকায় রাস্তার পাশে টিটুকে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বেতাগী থানার পুলিশের সহায়তায় তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুই ইউপি চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব
বেতাগীর সরিষামুড়ি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ইমাম হাসান শিপন জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। অপরদিকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ শরীফ বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সরিষামুড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি।
২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয় শিপন জোমাদ্দারকে। মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে ইউসুফ শরীফ পরাজিত হন।
এরপর থেকেই শিপন ও ইউসুফের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।
গত বছরের ২০ নভেম্বর বিয়ের দাওয়াত থেকে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন শিপন। কুপিয়ে তার দুই পা কেটে ফেলা হয়।
অভিযোগ ওঠে, শরীফের উপস্থিতিতে তার তিন ছেলে এবং সমর্থকরা শিপনের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালান। এ ঘটনায় শরীফের ছেলেসহ ১৪ জনের নামে বেতাগী থানায় মামলা হয়।
দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন শিপন।
চলতি বছরের ১৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দেয়া নিয়ে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী শিপন ও ইউসুফ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় টিটু মেম্বার শরীফের পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৪ মার্চ ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরিষামুড়ি ইউনিয়নের ভোড়া এলাকায় রাত ১০টার দিকে রফিক বিশ্বাস নামের এক যুবককে কুপিয়ে জখম করে ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় টিটুকে আসামি করে মামলা করা হয়।
ইউপি নির্বাচনের ঠিক আগের দিন ২০ জুন রাত ১০টার দিকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শরীফের স্ত্রীকে নিজ বাড়িতে কুপিয়ে জখম করা হয়।