ভারি বৃষ্টিতে গত ৬ জুন ডুবে যায় চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ এলাকা। মূল সড়কের কোথাও হাঁটুপানি আর কোথাও কোমর সমান পানি ওঠে। নিচু এলাকায় জমে গলা সমান পানি।
চলতি বর্ষায় অন্তত পাঁচবার ডুবেছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এ বন্দরনগরী।
চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা। এই সমস্যা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চার বছর আগে হাতে নেওয়া প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে আরও দুই বছর। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। কবে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেটিও বলতে পারছে না সিডিএ।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। কবে শেষ হবে সেটিও জানে না। এখন তারা (সিডিএ) জটিলতার কথা বলছে। তবে আমরা প্রকল্প শুরুর আগেই বলেছি, এই প্রকল্পে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তখন সিডিএ কারও কথা শোনেনি।’
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সিডিএ-এর প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। সিডিএর ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রথম দফায় ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে খালের আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকল্পের কার্যক্রম। ইতিমধ্যে নগরীর ৩৫টি খাল থেকে ৩ হাজার ১৭৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। এখন সিডিএ বলছে, এখন আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। এভাবে দুই দফায় মেয়াদ বাড়তে চললেও প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, খালের মুখে জলকপাটের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। খালগুলোর পাশে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে ৭০ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ৪২টি সিলট্র্যাপের মধ্যে মাত্র ২০টির কাজ শুরু হয়েছে। খালের দুই পাড়ে ৮৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের মধ্যে এ পর্যন্ত তিন কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। তবে সম্পন্ন হয়েছে ৫৪টি ব্রিজ-কালভার্টের নির্মাণকাজ।
প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী বলেন, ‘মূলত জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় সব কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। আমরা সিডিএকে বারবার বলছি, জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে দিতে। এদিকে এখন আবার নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ পাচ্ছি না। অনেক ঠিকাদারের বিল আটকে গেছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় ভৌত কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’
জলাবদ্ধতার সময় চট্টগ্রামে নগরের মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যায়। তাতে প্রতি বছর ক্ষতির সম্মুখীন হন নগরবাসী। কিন্তু জলাবদ্ধতায় প্রতিবছর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
তবে দেশের বৃহৎ ভোগপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রিজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম (এনআরপি) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা করে। এতে সহায়তা করে চট্টগ্রাম চেম্বার। ২০২০ সালে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতায় গত এক দশকে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
চাক্তাই খাল এলাকার ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী আবদুর রহিম রানা বলেন, ‘পানির কারণে কত ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। বৃষ্টি হলেই খাল উপচে পানি আড়তে ঢুকে যায়। মালামাল ভিজে নষ্ট হয়। এই সমস্যার সমাধান দেখছি না। এখন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।’
সিডিএ-এর সক্ষমতা না থাকা সত্বেও এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, ‘কারও মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকল্পগুলো নিয়েছে সিডিএ। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি। এখন বিভিন্ন অজুহাত তুলছে সংস্থাটি। কিন্তু অজুহাত তোলার সুযোগ নেই। এ জন্য সিডিএকেই একক দায় বহন করতে হবে।’
তবে সক্ষমতা না থাকার অভিযোগ মানতে রাজী নন সিডিএ-এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, ‘খালগুলো অনেক প্রভাবশালী দখল করেছে। সরকারি অনেক সংস্থা খাল দখল করে অবকাঠামো তৈরি করেছে। এসব খাল দখলমুক্ত করতেও অনেক সময় লেগেছে। খালের পাড়ে অনেক ব্যক্তি মালিকানা জায়গা রয়েছে। এসব জায়গা অধিগ্রহণেও সময় লাগছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। তারপরও দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা রয়েছে।’
প্রকল্পে প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, করোনার কারণে গত বছর আমাদেরকে মন্ত্রণালয় চাহিদার চেয়ে কম টাকা ছাড় দিয়েছিল। কম টাকা বরাদ্দের কারণে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তাই এবার চাহিদামতো টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তারা। ফলে আর টাকার সমস্যা নেই।’
এদিকে সিটি করপোরেশন, সিডিএসহ সেবা সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় না হলে শহর জলাবদ্ধতামুক্ত হবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’-এর আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন শুধু সিডিএ-এর কাজ নয়। এখানে খাল-নালা পরিষ্কারের দায়িত্বে রয়েছে সিটি করপোরেশন। পানি উন্নয়ন বোর্ডও জড়িত। তাই শুধু সিডিএকে দৌঁড়ালে হবে না। অন্যদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন হবে না।’