মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। ট্রলার নিয়ে ইলিশ ধরতে নামছেন উপকূলের আড়াই লাখ জেলে। এরই মধ্যেই সাগরযাত্রার প্রস্তুতি শেষ করেছেন জেলেরা।
পাইকার-আড়তদারের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে মৎস্য বন্দরগুলো।
উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল উপকূলের আড়াই লাখের বেশি জেলে। মধ্যরাতে তারা সাগরে যাত্রা করবে।’
তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে না হতেই বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছি আমরা। এ অবস্থায় গভীর সমুদ্রে গিয়ে ইলিশ শিকার সম্ভব নয়। ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি নিরাপদে থেকে ইলিশ শিকারের জন্য বলেছি।
‘গভীর সমুদ্রগামী জেলেরা সারা বছরই সাগরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। এতেই তাদের সারা বছরের জীবিকা। দাদন নিয়ে বছর পার করা এসব জেলে মাছ ধরে দাদন শোধ করেন।’
উপকূলের অন্যতম বৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পটুয়াখালীর মহিপুর আড়তদার মালিক সমিতি ও বরফ কল মালিক সমিতির নেতা গাজী মজনু বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শ্যাষ অইছে, এহন সাগরে যাইয়া মাছ শিকার করবে জাইল্লারা। তয় এইবারের যদি মাছ না পাওন যায়, তয় মোগো এই ব্যবসা চালাইন্না যাইবে না আর।’
মাছসংশ্লিষ্টরা জানান, ৬৫ দিন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় মৎস্য বন্দর ও জেলে পল্লিগুলো নীরব ছিল। বন্ধ ছিল উপকূলীয় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলো। কয়েক হাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিক বেকার দিন কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। এ সময় তালিকাভুক্ত জেলেরা খাদ্যসহায়তা পেয়েছেন। তবে তালিকার বাইরের কয়েক হাজার জেলে সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটিয়েছেন।
বরগুনার পাথরঘাটায় দেশের বৃহত্তম ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র। কক্সবাজার, ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় জেলেরা সাগরে ইলিশ ধরার প্রস্তুতি নিয়ে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন।
পাথরঘাটার দক্ষিণ কুপদোন এলাকার জেলে সিদ্দিকুর রহমান আকন বলেন, ‘দুউডা মাস নিষেধাজ্ঞার লইগ্গা সাগরে যাইতে পারি নায়। মোরা আইজগোই রাইত বারোটার পর মাছ ধরতে সাগরে যামু। এতদিন পর ইলিশ শিকার করমু, খুব খুশি লাগতেছে।’
কক্সবাজার থেকে এসে পাথরঘাটার বিএফডিসি ঘাট খালে নোঙর করা ট্রলার এফবি মায়ের দোয়ার মাঝি আবদুর রশিদ বলেন, ‘বেকার সময় কাটাইছি, টেকাপয়সা ধারদেনা কইরা জাইল্লাগো লইয়া সাগরে যাইবার জইন্নে রেডি হইছি, মনে বহুত আশা নিয়া রাত্তিরেই মাছ ধরতে রওয়ানা করুম।’
বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নের চরকগাছিয়া এলাকার মা-বাবার দোয়া ট্রলারের মাঝি জাকির হোসেন খান বলেন, ‘৩০ বচ্ছর ধইর্যা সাগরে মাছ ধরি, সাগরেই জীবনডা কাডাইলাম। নিষেধাজ্ঞা মাইন্না মাছ ধরি নাই, আইজগো রাইতে রওয়ানা করমু, আল্লায় যদি দেয় তয় ট্রলার ভইররা ইলিশ লইয়া ঘাডে ভিরমু।’
নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে না হতেই সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন জেলেরা। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার মোল্লা জানান, জেলেদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলেদের প্রতি সহনশীল আইন ও নীতিমালা না হলে জেলে পেশায় লোক পাওয়া যাবে না।
মৎস্য সমিতির এই নেতা আরও বলেন, ‘৬৫ দিনে ৮৬ কেজি চাল, এটা একদমই দায়সারা। জেলেদের নিয়ে সরকারের আরও ভাবা উচিত।’
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার দেব বলেন, ‘জেলার প্রায় ৪০ হাজার জেলেকে নিষেধাজ্ঞাকালীন খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্রগামী জেলেরা কেউ সহায়তার বাইরে আছেন কি না, আমরা খোঁজ নিচ্ছি। প্রকৃত জেলেরাই যাতে সহায়তার আওতায় থাকেন, এ চেষ্টাই করছি আমরা।’
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, সাগরে মাছের প্রাচুর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১৯ সাল থেকে প্রথমবারের মতো মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসে। মাছের প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময়ে দেশের সামুদ্রিক জলসীমানায় সব ধরনের মৎস্য আহরণ, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
ইলিশ ধরতে জেলেরা রয়েছেন অপেক্ষায়
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক ড. অলিউর রহমান জানান, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন উপকূলের বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও মঠবাড়িয়ার ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৮৪ জন জেলেকে ঈদের আগে সরকারি সহায়তার প্রথম কিস্তি (৩০ দিন) ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তির (৩৫ দিনের) ৪৬ কেজি চাল শিগগির দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
শঙ্কায় পটুয়াখালীর জেলেরা
পটুয়াখালী মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী প্রতিবছরের মতো এবার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা হয়েছিল।মধ্যরাতে সাগরে যেতে শুক্রবার ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে উপকূলের জেলেদের। ট্রলারগুলোতে বাজারসওদা করে ফেলেছেন। রাত ১২টার পরই জেলেরা পুরোদমে নদী ও সাগরের উদ্দেশে ট্রলার ভাসাবেন।
মৎস্য বন্দর মহীপুর ও আলীপুরে দেখা গেছে আড়তগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে।
কয়েক যুগ সাগরে ইলিশ শিকারি জেলে মুছা হাওলাদার বলেন, ‘ভরা মৌসুমে সাগরে অবরোধ দিয়া আমাগো মাছ ধরা বন্দ রাখছে, এহন আদৌ ইলিশ পামু কি না হ্যাও জানি না। অথচ এই সময়ে পাশের দ্যাশের জাইল্লারা অবাদে মোগো এলাকায় ঢুকে মাছ ধইরা নিয়ে যায়।’
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা জানান, গত বছর উপকূলে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ আহরণ হলেও এবার দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। ভরা মৌসুমে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা শেষে দুই মাস পর অক্টোবরে আবার ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকবে, সব মিলিয়ে ভাবিয়ে তুলছে কুয়াকাটার ব্যবসায়ীদের।
মাছ ব্যবসায়ী সুলতান মিয়া জানান, নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অন্য দেশের জেলেদের অবাধে মাছ শিকারেও ভাবিয়ে তুলছে তাদের।
মহীপুর মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ী দিদার উদ্দিন মাসুম জানান, গভীর সাগরে বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলারের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গত দুই বছর ধরে গোটা সাগরে অবরোধ জারি করায় তারা হতাশ। যে কারণে দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য ব্যবসা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল্ল্যাহ্ জানান, জেলেদের এই দাবি যুক্তিসংগত। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।
তিনি জানান, পাশের দেশের সঙ্গে পরামর্শ করে একই সময়ে সাগরে অবরোধ দেয়া গেলে মৎস্যসম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বাগেরহাটের মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম তানভীরুল হক জানান, নিষেধাজ্ঞায় জেলেদের সাময়িক ক্ষতি হলেও দেশে মৎস্যসম্পদ আরও বৃদ্ধি পাবে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।
মৎস্য বিভাগ জানায়, পটুয়াখালী জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৬৬০ জন। এর মধ্যে সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮০৫ জন। এ ছাড়া আরও প্রায় ২০ হাজার সমুদ্রগামী জেলে রয়েছেন অনিবন্ধিত।