লাখ লাখ মানুষের জমায়েত ময়দানটিকে সারাদেশে পরিচিত করে তুলেছিল। কত মানুষ নামাজের জন্য এসেছেন, সেই হিসেব কষা হতো ঈদের জামাতে। কিন্তু মহামারিকাল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানকে ঘিরে সেই হিসেবনিকেশ বন্ধ করে দিয়েছে।
শোলাকিয়া মাঠের জামাত নেই বলে আক্ষেপ নিয়েই ঈদ করল কিশোরগঞ্জবাসী। পর পর চারটি ঈদে বিখ্যাত এই ময়দানটিতে খাঁখাঁ শূন্যতা দেখা গেছে।
নরসুন্দা নদীর তীরে দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত হতো এই ঈদগাহ ময়দানটিতে। এই ময়দানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে এবার ১৯৪ তম ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
এই ময়দানের আয়তন সাত একর। পুরো ঈদগাহ ময়দানের চারপাশে উচু দেয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা হয়েছে। তবে মুসল্লীদের মাঠের সবদিক থেকে প্রবেশ ও বের হতে করতে পারে এবং বের হতে পারে দেয়ালের মাঝে মাঝে ফাঁকা রাখা হয়েছে।
শোলাকিয়া মাঠে ঈদের জামাতের জন্য ২৬৫টি সারি হয়। প্রতিটি সারিতে প্রায় ৫০০ করে মুসল্লি দাঁড়াতে পারেন। সব মিলিয়ে শুধু মাঠের ভেতরেই প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
তবে মাঠের সমপরিমাণ মুসল্লি নামাজ আদায় আদায় করেন মাঠের পাশের সড়ক ও খোলা জায়গায়। সবমিলিয়ে এই ময়দানে প্রায় তিন লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।
শোলাকিয়া সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রনি আহমেদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ঈদ এলেই এখানে লাখ লাখ মানুষ নামাজ পড়তে আসেন। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসল্লিরা ঈদের আগের দিনই চলে আসতেন শোলাকিয়ায় নামাজ পড়ার জন্য। রাতে শহরের হোটেলে রাত্রিযাপন করে সকালে মাঠে নামাজ আদায় করতেন।
‘কেউ কেউ মাঠেও রাত্রিযাপন করতেন। কিন্তু গত বছর থেকে করোনা মহামারির কারণে ঈদের জামাত বন্ধ রয়েছে এই মাঠে। গত বছর থেকে আমরা ছোট পরিসরে মসজিদের ভেতরে নামাজ আদায় করছি। লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটত যে মাঠে, সে মাঠ এখন ফাঁকা।’
ওই এলাকার চায়ের দোকানি জালাল মিয়া বলেন, ‘গত দুই বছর ধইরা ঈদ আইয়ে ঠিহই। কিন্তু এই মাঠটা থাহে খালি। ঈদের জামাত বন্ধ। কেউ আইয়ে না। অন্য বছর ঈদের আগের দিনই মাঠ সাজানির লাগি শত শত মানুষ কাম করত। গতবার আর এইবার মাডের এই সৌন্দর্যডা নাই। দুইবছর ধইরা ঈদে কোনো বিহি-কিনি নাই আমার দোহানো। ঈদগানার লগে গরুর বাজারটা থাহনে কয়ডা চা বেছতাম পারছি।’
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের মোতাওয়াল্লি দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান মঈন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইতিহাসে এ নিয়ে দুইবার ঈদুল আযহার জামাত বন্ধ রয়েছে। এই বিষয়টা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের এবং বেদনার। তবে মহামারির কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
করোনা মোকাবিলা করে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও এই ময়দান ফিরে উৎসবমুখর পরিবেশ এমন প্রত্যাশা তার।
লোকমুখে জানা যায়, ১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের জামাতে একসঙ্গে প্রায় সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলেন। আর তখন থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। পরে এই মাঠ শোলাকিয়া নামে পরিচিতি পায়।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি শামীম আলম জানান, গত ১৫ জুলাই ঈদগাহ কমিটির জরুরি সভায় ঈদুল আজহার জামাত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঈদের নামাজের জন্য লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম হয়। তাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এখানে এবারের ঈদুল আজহার জামাত না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
‘এবার মসজিদেও ঈদুল আজহার জামাত বড় পরিসরে যাতে না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া ছিল। শহরের বিভিন্ন মসজিদে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নিজেদের বহুতল আবাসিক ভবনের ছাদে যেন নির্দিষ্ট ভবনের সবাই মিলে জামাত করেন সে বিষয়েও আমরা উদ্বুদ্ধ করেছিলাম।’