বিপ্লব হোসেন, ক্ষুদ্র খামারি। প্রতিবছরই কয়েকটি গরু পালন করেন।
কুষ্টিয়ার কবুরহাট কদমতলায় তার বাস। সেখানে রয়েছে গবাদিপশুর খাবার বিক্রির দোকানও।
বিপ্লব এবার হৃষ্টপুষ্ট করা তিনটি গরু বিক্রির জন্য ১৬ জুলাই ঢাকায় রওনা হন। তার তিনটিসহ আরও তিন জনের মোট ১০টি গরু নিয়ে ট্রাক যখন ঢাকার দিকে তখন খবর পান জায়গা নেই কোনো হাটে।
গরুতে ঠাসা। সিদ্ধান্ত বদলে রওয়ানা হন চট্টগ্রামের দিকে।
সেখানে সাগরিকা হাটে গিয়েও দেখেন গরু রাখার জায়গা নেই। হাটের কাছে রাস্তার পাশে গাছের সঙ্গে বাঁধেন তাদের ১০টি গরু। সেখানেই দাম-দর চলতে থাকে।
প্রত্যাশার দামের অর্ধেক ওঠেন ক্রেতারা। এক পর্যায়ে সঙ্গী নুরু হোসেন তার ছয় লাখ টাকার গরু সাড়ে তিন লাখে বেচে দেন। এ ভাবে বেচেছেন অন্যরাও। কিন্তু বিপ্লব বিক্রি করেননি।
তার প্রত্যাশার দেড় লাখের গরুর দাম ওঠে ৮০ হাজার পর্যন্ত। বিপ্লব বলেন, ট্রাক ভাড়া হিসাবে তার ৫০ হাজার টাকা লোকসান হলো। কিন্তু গরু বেচে দিলে লোকসানের পরিমাণ লাখের ওপরে যেত। তারপরও বেচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কম দামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গরু ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন।
ঈদের আগের দিন গরু নিয়ে রওনা দেন বাড়ির দিকে। এত লোকসান, স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেও মানিকগঞ্জে পুলিশকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। ঈদের দিন সন্ধ্যা ৬টায় বাড়িতে পৌঁছেছেন।
নিউজবাংলাকে বিপ্লব বলেন, ‘আশা ছিল ঠিকমতো গরু বেচে আসতে পারলে ঈদের আগের রাতে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁস জবাই করে পিকনিক করব। কিন্তু গরু বিক্রি হয়নি, ফেরাও হয়নি ঈদের আগে।‘
করোনার কারণে কোরবানি হয়েছে কম, লোকসান কমাতে পশু নিয়ে ফিরতে দেখা যায় বিক্রেতাদের
তার মতো অর্ধেকের বেশি গরু ফিরিয়ে আনতে হয়েছে কুষ্টিয়া এলাকার খামারি ও ব্যবসায়ীরা। যেভাবে ট্রাকে করে নিয়ে গিয়েছিল সেভাবেই আবার ফিরিয়ে আনা হলো গরু। এতে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ল এই এলাকার খামারিরা।
বিক্রি না হওয়ায় ঈদের দিন সকাল থেকেই ফিরতে থাকে গরুর ট্রাক। পাটুরিয়া ঘাটের কাছে জট লাগায় সারা দিনেও আসতে পারেনি সব ট্রাক।
খামারি ও ব্যবসায়ীরা বলেন, তিন ভাগের একভাগ গরুও বেচতে পারেননি তারা। ক্রেতারা দাম কম বলায় পরিবহন খরচের লোকসান মাথায় করেও গরু ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। সারা দিন বৃষ্টি হওয়ায় ট্রাকের ওপরই ভিজেছেন তারা।
ঈদের আগের রাতে ঢাকা থেকে বাড়ির পথে মানুষের ঢল যখন বন্ধ হয়ে গেছে, তখন ট্রাকের পর ট্রাক গরুবাহী রাজধানী ছাড়তে দেখা যায়। ঈদের দিনও অব্যাহত ছিল এই যাত্রা।
ঈদের দুই দিন আগেও রাজধানীতে গরুর দাম ছিল চড়া। তবে আগের দিন পড়ে যায় দাম। এতটাই পড়ে যে লাভের আশা বাদ দিয়ে লোকসান কমানোর চিন্তা করতে হয় ব্যাপারি ও খামারিদের।
এবার হাটে চাহিদার চেয়ে গরু এসেছে বেশ। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া শাটডাউন ঈদকে ঘিরে আট দিনের জন্য শিথিল করার ঘোষণা আসার পর এত মানুষ রাজধানী ছেড়ে যাবে, সেই ধারণা ছিল না।
এবার মানুষ ঢাকায় থাকবে বেশি, এই হিসাব করে বেশি করে গরু এনেছিলেন ব্যাপারিরা। কিন্তু সেই হিসাব ফলেনি। এর পাশাপাশি করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা, চাকরি হারানো, কারও কারও বেতন কমে যাওয়া, বোনাস না হওয়ার কারণে মানুষের হাতে টাকাও ছিল কম। অনেকেই কোরবানি দেননি, যারা একা কোরবানি দিতেন, তাদের কেউ কেউ আবার ভাগে দিয়েছেন। এ কারণেও গরুর চাহিদা কম থাকতে পারে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসেবে, শুধু কুষ্টিয়া জেলাতেই হৃষ্টপুষ্ট করা হয় আড়াই লাখ গরু। এর এক লাখই যায় রাজধানীর হাটে। এর অর্ধেকের বেশি এবার ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসেছে বলে মনে করেন জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে এবার কোরবানি কম দিয়েছে মানুষ।‘
যারা গরু ফিরিয়ে এনেছেন তাদেরকে আরও দুই-তিন মাস খাইয়ে বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সিদ্দিকুর বলেন, ‘কোরবানির গরু বেশি দামে কেনার মতো আবেগ এবার মানুষের নেই। সবাই জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত।‘