ঈদুল আজহায় সাধারণত সামর্থবানরা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানির পর পশুর মাংসের একভাগ বিলি করা হয় হতদরিদ্রদের মাঝে। দিনভর মাংস সংগ্রহের পর তা পরিবারের সদস্যদের মুখে তুলে দেন নিম্নআয়ের মানুষ।
তবে প্রচলিত এই ধারণার ব্যতিক্রম চিত্র দেখা মেলে কিশোরগঞ্জে। সেখানে কোরবানি দেন হতদরিদ্ররাও। আর এই পশু কেনার টাকা জমা করেন সারা বছর ধরে। প্রতিদিন জমা দেয়া টাকা থেকে আসে ঈদের বাজার সদাইয়ের খরচও।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নের ১৪ জন নিম্নআয়ের মানুষ করেছেন ‘হতদরিদ্র সমিতি’। সমিতির সদস্যরা প্রতিদিন জমা রাখেন ১০ টাকা করে।
৬ মাসে যে টাকা জমা হয় তা আবার দেয়া হয় ঋণ আকারে। সেই টাকা থেকে আসা মুনাফা জমা হয় হিসাবে।
জমানো টাকা থেকে গরু কেনার পর বাড়তি যে টাকা থাকে সে টাকা ভাগ করে দেয়া হয় প্রত্যেক সদস্যকে। এতে করে ঈদের বাজার সদাইও করে ফেলতে পারেন তারা।
চলতি বছর এই সমিতির হিসাবে জমা পড়ে ৮৫ হাজার টাকা। সেখান থেকে ৭৬ হাজার টাকায় কোরবানির জন্য গরু কিনেছেন সদস্যরা।
বৌলাই হতদরিদ্র সমিতির সভাপতি মো. মাহতাবউদ্দীন বলেন, ‘এলাকায় অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি আছে যারা, নিজেরা কোরবানি করে ঠিহই, কিন্তু আশেপাশের প্রতিবেশীদের দিকে চাইয়াও দ্যাহে না। কোরবানির মাংস বণ্টনও এরা সঠিকভাবে করে না। ঈদের দিনে সারাদিন ঘুরে না খাইয়া থাকলেও কেউ খবর নেয় না।
‘আমরার মতো হতদরিদ্রদের সন্তানরাও তো এদিন ভাল কিছু খাইতে চায়। কিন্তু সারা দিনে দুই টুকরা, চার টুকরা করে যে পরিমাণ মাংস তাতে সন্তানদের চাহিদা মিটে না। তাই আমরা হেরার দিকে চাইয়া না থাইক্ক্যে নিজেরাই কোরবানির উদ্যোগ নিছি। আমরা ১৪ জন মিলে পাঁচ বছর আগে একটা সমিতি করছি। সমিতির নাম দিসি হতদরিদ্র সমিতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন প্রত্যেক সদস্য ১০ টেহা কইরে জমা করি, বছর শেষে এই টেহাডা দিয়া আমরা কোরবানির গরু কিনি। কিন্নে আমরা আমরাই কোরবানি দেই। এই বছর আমরা জমা করছি ৮৫ হাজার টেহা। গরু কিনতে লাগছে ৭৬ হাজার টাকা। বাকি যে টেহাডা রইছে হেই টেহাডা আমরা সবাই মিইল্যা ভাগ কইরে নিয়া ঈদের বাজার করি।
‘ঈদের পরের দিন থাইক্ক্যে (থেকে) আরেকবার টেহা জমানি শুরু করমু। আমরা সমিতি করার পরে থাইক্ক্যে আর বড়লোকরার মাংসের অপেক্ষায় থাহি না। মন চাইলে ঘরে আইসা দিব, না দিলে নাই।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। তিনি পেশায় রিকশাচালক। তিনি বলেন, ‘আমরা যেরা যেরা মিইল্ল্যা এই সমিতিডা করছি, আমরা সবাই গরিব মানুষ। কেউ রিকশা চালায়, কেউ ভ্যান চালায়। কেউ টুকটাক ফুটপাতো বইয়া ছুডুখাডু ব্যবসা বাণিজ্য করি।
‘সারাদিন যেই টেহা রুজি করি, এই টেহাত থাইক্ক্যে সমিতির লাইগ্গ্যে ১০ টেহা আলাদা রাইখ্যা দেই। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সভাপতি মাহতাব ভাইয়ের কাছে জমা দেই। বছরটা ঘুইরে আইলে যহন হুনি ৮০-৯০ হাজার অইছে তহন খুব ভালা লাগে। এই সমিতিডা তাহনে অহন আমরা নিজেরাই কোরবানি দিতাম ফারি। অহন আর মাইনষের মাংসের দিকে চাইয়া তাহন লাগে না।’
সমিতির সদস্য হাবিবুর রহমান। হাবিবনগর এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ‘যহন মাইনষের বাড়িত ফিরিজ আছিন না তখন ঈদ আইলে মাংস বেশি দিত। আর অহন ঘরে ঘরে ফিরিজ। এই ফিরিজ আওনের পরে থাইক্যে আমরার বন্ডকও (বণ্টন) ছুডু অইয়া গেছেগা। দুই টুরহা, আর চাইর টুরহা কইরে সারাদিনে যেই পরিমাণ ফাই এইতা দিয়ে নিজেরা কী খাইমু ফুলাফানেরই অয়না। হের লাইগ্যে আমরা চাঁদা তুইল্ল্যে সমিতি করছি। অহন প্রতিবছরই আমরাও কোরবানি দিয়া মাংস বন্ডক কইরে নিজেরা খাই।’
সমিতির আরেক সদস্য মো. আলালউদ্দীন। আগে হোটেলে কাজ করতেন। কিন্তু বয়সের ভারে এখন কিছুই করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘আমরার সমাজের এমন অনেক মানুষ আছে যেরা কোরবানি দিয়া মাংস সঠিক কইরে বন্ডক করে না। নিজেরার ফিরিজ ভইরে থাকলে মাইনষেরে দেয়।
‘হের লাইগ্যে আমরাও হেরার আশা ছাইরে দিসি। অহন আমরা নিজেরা কোরবানি দিয়া নিজেরাই খাই। আর আমরার মতন যেরা আছে হেরারেও দেই।’
বৌলাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে হতদরিদ্ররা মিলে কোরবানি করে আসছে আরও আগে থেকেই। পুরো ইউনিয়নে এমন সমিতি আছে ২০ থেকে ৩০টি। প্রতি বছরই তারা নিজেরা চাঁদা তুলে টাকা জমিয়ে কোরবানি করে থাকে।’