সকাল ৬টায় রাজধানী ঢাকার বাড্ডা থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি জামালপুরের উদ্দেশে ট্রাকে চড়ে রওনা হন চাকরিজীবী আরিফ হোসেন। আব্দুল্লাহপুর পার হতেই সময় লাগে চার ঘণ্টা।
সকালে মুষলধারে হওয়া বৃষ্টিতে ট্রাকের ছাদে ভিজেছেন শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে।
বেলা ১১টায় তার সঙ্গে টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় কথা হয়। জানান, জামালপুর যেতে বাস ভাড়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হলেও এখন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে ট্রাকে চড়ে যেতে হচ্ছে। বাসে সিট নেই তাই বাধ্য হয়ে এভাবে যাচ্ছেন।
আগের রাতের ভোগান্তি ছিল আরও বেশি। রাতভর এই সড়কে গাড়ি চলেছে শম্বুক গতিতে। জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে ঢাকার বনানী পর্যন্ত গাড়ি একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে ছিল।
গাড়ির চাপে ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পার হতেই আট থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে গেছে।
এই সড়ক ধরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাশাপাশি উত্তরের পথের যাত্রীরা চলাচল করেন। আর তীব্র যানজটে ভুগেছেন সবাই।
বাড়ি ফেরা মানুষের চাপে এই মহাসড়কে যানজট কোনো ঘটনা না হলেও এবার করোনাকালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি নজিরবিহীন।
যানজট দেখা গিয়েছে গাবতলী থেকে সাভার হয়ে টাঙ্গাইল ও আরিচা মহাসড়কেও। তবে গাজীপুরের মতো অতটা তীব্র ছিল না। আর চার লেন হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম আর ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয়।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে গত কয়েক বছর ধরে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এ জন্য ঈদযাত্রায় ব্যাঘাত নতুন নয়। তবে এবার এই পথ ব্যবহারকারীদের ভোগান্তি চরমে ওঠার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা উঠে এসেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের মূল্যায়নে।
কখনও সড়কের একপাশে কখনও উভয় পাশে থেমে থাকে গাড়ির চাকা
বিআরটির কাজ চলার কারণে স্বাভাবিক যান চলাচলে ব্যাঘাতের পাশাপাশি মহাসড়কে গণপরিবহনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রাক ও পশুবাহী গাড়ির একসঙ্গে চলাচল, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচলের সরকারি নির্দেশ, দেরিতে পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত, শেষ সময়ে অফিস, পোশাক কারখানা ছুটি এবং লকডাউন শিথিলের ঘোষণার বিষয়টি উঠে এসেছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘অন্যান্য বছর শুধু যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল করে। কিন্তু এবার ঈদে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং পশুবাহী গাড়ি বেশি থাকায় যানজট বেশি।’
তিনি বলেন, ‘গাজীপুর থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক খানাখন্দে ভরা। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সঙ্গে উন্নয়নকাজ চলমান। কাজ চলমান থাকায় একদিকে সড়ক সরু হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে অধিক যানবাহনের চাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট তৈরি হয়েছে।’
যেসব কারণ
অন্যান্য বছর ঈদে মহাসড়কে যানজট এড়াতে শুধু যাত্রীবাহী বাস আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যবাহী গাড়ি চলত। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বন্ধ থাকত।
তবে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া শাটডাউন ঈদ উপলক্ষে আট দিনের জন্য শিথিল করার পর পণ্যবাহী গাড়ির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এর সঙ্গে পশুর ট্রাক মিলে সড়কে গাড়ির চাপ এবার সব দিক থেকেই বেশি। ফলে যে মোড়ে ক্রসিং দিতে হয়, সেখানে সময় লাগছে বেশি।
সড়কে ভিড় বাড়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলার বিষয়টি। আবার এবার সব ট্রেন ছাড়েওনি।
প্রতিবছর ঈদে ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় চোখে পড়ে। অনেকেই ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রেনের ছাদে করেও বাড়ি ফেরেন। তবে এবার আর সে সুযোগ নেই। সরকারি নির্দেশে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে চলাচল করছে সেগুলো। ফলে চাপ বেড়েছে সড়কে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগরা বাইপাস এলাকা থেকে ৫০০ টাকা ভাড়ায় খোলা পিকআপে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন গার্মেন্টসকর্মী সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর ট্রেনে বাড়ি যাই। এবার টিকিট না পেয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু বাসও পাইনি। তাই পিকআপেই রওনা দিলাম। গাড়ি ছাড়ার কিছু সময় পরই বৃষ্টিতে ভিজে গেছি।’
তৃতীয় যে কারণটি উঠে এসেছে, সেটি হলো এবার ঢাকায় পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত এসেছে দেরিতে। চার দিন সময় রেখে ১৭ জুলাই থেকে শুরু হয় হাটগুলো। অন্যান্য বছর ব্যাপারীরা ঢাকা থেকে আরও আগেভাগে পশু নিয়ে আসতে থাকেন। কিন্তু এবার হাতে সময় কম থাকায় পশুবাহী গাড়িগুলো একসঙ্গে ঢুকেছে। আবার মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় পশুবাহী ট্রাক বিকল হয়ে পড়ায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর ৩০০ ফিট হাট থেকে গরু বিক্রি করে ট্রাকে চড়ে বাড়ি ফিরছেন কয়েকজন ব্যাপারী। উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকা পড়েছিলেন তারা।
একজন বলেন, ‘১৬ তারিখ পাবনা থেকে গরু নিয়া হাটে আইছি। সব গরু বেচা শেষ, তাই এখন বাড়ি ফিরা যাইতেছি। আসার সময় রাস্তায় গরু নিয়া অনেক কষ্ট করছি। এহন যাওয়ার সময়ও একই অবস্থা। এক ঘণ্টা ধইরা এক জায়গায় বইসা আছি। গাড়ি লড়েও না, চড়েও না। ঈদের দিন সকালের আগে বাড়ি ফিরতে পারমু কি না সন্দেহ আছে।’
চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শাটডাউন শিথিলের বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিক সময়ে বাড়ি ফিরতে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় অনেকে স্বজনদের আগেভাগে পাঠিয়ে পরিবারের অন্যরা ঈদের আগে আগে যেতেন। ফলে একসঙ্গে সড়কে চাপ পড়ত কম।
ঈদুল ফিতরে গণপরিবহন বন্ধ থাকার ঘোষণা এসেছে আগেভাগেই। এবারও এই পরিস্থিতি থাকবে- এটা যখন ভাবা হচ্ছিল, তখন ১৫ জুলাই থেকে আট দিনের জন্য সব বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা আসে।
কিন্তু ১৫ জুলাই থেকেই বাড়ি ফেরার চাপ ছিল কম। কারণ ১ জুলাই থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস বন্ধ থাকায় জরুরি কাজও আটকে থাকে অনেকের। সেগুলো শেষ করে ঈদের আগে আগে রওনা হওয়ায় মূল স্রোতটা তৈরি হয়। আর সমস্যাসংকুল এই সড়ক নিতে পারেনি বাড়তি মানুষের চাপ।
পোশাক কারখানাও ছুটি হয় সোমবার বিকেলে। আর শ্রমিকদের চাপটাও সে সময়ই তৈরি হয়। এটিও বিকেল থেকে দুঃসহ যানজটের আরেক কারণ।
আবার শাটডাউনে পোশাক কারখানা খোলা থাকলেও ঈদের পর থেকে দুই সপ্তাহ তা বন্ধ থাকার সিদ্ধান্তই আছে এখন পর্যন্ত। এ কারণে বড় ছুটি পাওয়া যাবে বলে শ্রমিকদের মধ্যেও বাড়ি ফেরার প্রবণতা এবার বেশি। ভাড়া বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের এসব মানুষ গাদাগাদি করে ট্রাক ও পিকআপে করে রওনা দিয়েছেন। বাসের পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে এ কারণে।
পঞ্চম যে কারণটি উঠে এসেছে, সেটি হলো বিআরটি প্রকল্পে নির্মাণকাজে ধীর গতি।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে প্রকল্পটি। অতি সহজে ও কম সময়ে রাজধানীর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের জন্য এ প্রকল্পটি নেয়া হয়। ২০১২ সালে নেয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় কয়েক দফায় বাড়িয়েও মাত্র ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা না করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ায় কয়েক লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে।
এই প্রকল্পের কারণে এই সড়কে উন্নয়নকাজ হয় না। বিভিন্ন স্থান গেছে ভেঙে। বৃষ্টির কারণে তৈরি হওয়া কাদার জন্য গাড়ির স্বাভাবিক গতি হয়েছে আরও ধীর।
বর্ষা মৌসুমের প্রথম থেকেই ১২ কিলোমিটার এ সড়ক যেন মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী বাজার, স্টেশন রোড, চেরাগআলী, কলেজ গেট, বোর্ডবাজার, কুনিয়া তারগাছ, ঢাকা বাইপাস মোড় ও ভোগড়া এলাকায় সড়কে খানাখন্দ সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে ড্রেন নির্মাণকাজ চলমান হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
নির্মাণসামগ্রী রাখায় সড়ক হয়ে গেছে সরু। অন্যান্য বছর আগেভাগে প্রস্তুতি থাকে বলে ঈদযাত্রার আগে আগে এই এলাকাগুলো চলাচল উপযোগী রাখা হয়। কিন্তু এবার শাটডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে আসায় সে সময়ও ছিল না।