খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় গুলি করে সাবেক কর্মীকে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল দল)।
সংগঠনের খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক অনি চাকমা রোববার এক বিবৃতিতে এ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতিতে তিনি জানান, নিহত কুমার ত্রিপুরা এক সময় ইউপিডিএফের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এক বছর আগে তিনি দলীয় কাজ থেকে অবসর নিয়ে সাধারণ জীবন-যাপন করছিলেন।
এরপরও তাকে গুলি করে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের কর্মীরা।
উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে নষ্টের জন্য একটি গোষ্ঠী আবারও মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে খুন-খারাবির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি জিইয়ে রাখতে চায়।’
অবিলম্বে কুমার ত্রিপুরার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার এবং সন্ত্রাসীদের মদদদাতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধের দাবি জানান তিনি।
উপজেলার উল্টাছড়ি ইউনিয়নের মরাটিলা এলাকায় রোববার সকালে হত্যার এ ঘটনা ঘটে।
মরাটিলা গ্রামের প্রধান বাদশা কুমার ত্রিপুরা নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, ‘এলাকায় আমার একটি দোকান আছে। সেখানেই সকালে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমার। হয়তো নাশতা করতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় অনেকেই সেখানে ছিল। সে সময় কেউ একজন তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমি সেখানে যাই।’
বাদশা জানান, ঘটনার আগের দিন থেকে ইউপিডিএফ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) পক্ষের সশস্ত্র সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারের জন্য ওই এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন।
পানছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেন জানান, কে বা কারা গুলি করেছে, তা জানা যায়নি। মরদেহটি উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এলাকায় সেনা ও বিজিবির তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
পাহাড়ের দায়িত্বরত নিরাপত্তা বাহিনী ও সেখানে সংঘাতের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এ ধরনের সংঘাতে অন্তত ৪২ জনের প্রাণ গেছে।
পাহাড়ের বাসিন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী মনে করছে, অনৈতিক কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত, হানাহানি বেড়েই চলেছে। আঞ্চলিক দলগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব, চাঁদা আদায়, ভাগবাঁটোয়ারাকেই সংঘাত-হানাহানির মূল কারণ বলে মনে করেন এলাকার লোকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর বাজারের এক বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৃথক চারটি ধারার রাজনীতির কাছে আমরা জিম্মি। একটি দলের পক্ষে অবস্থান নিলে অন্য পক্ষগুলো ক্ষুব্ধ হয়। প্রায়ই আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিবাদ করলে বা নীরব থাকলেও খুন, গুম বা অপহরণ হতে হয়।’
তবে আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের হতাশা থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ত্রিদিব চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পার্বত্য এলাকায় সমস্যা সমাধান হবে না। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্যই চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু ২২ বছর হতে চললেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ে কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের দল জড়িত ছিল না। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে যাদের বেশি ক্ষতি হবে তারাই চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা তৈরি করছে। আমরাও চাই পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা থাকুক। সবাই নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করুক।’
ইউপিডিএফের সংগঠক অংগ মারমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ে অশান্তির মূল কারণ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া। চুক্তি বাস্তবায়নে যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলো ন্যূনতম বাস্তবায়ন হয়নি। এ জন্য এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
সংঘাতের কারণ জানতে চাইলে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, ‘প্রসীত খীসার ইউপিডিএফের জন্য আজ পাহাড়ে এত সংঘাত। তারা তখন চুক্তির বিরোধিতা না করলে হয়তো পাহাড়ে আজ চারটি আঞ্চলিক সংগঠন হতো না। পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক, এটা আমরা সব সময় চাই।’
পাহাড়ের রাজনীতির মারপ্যাঁচ
পাহাড়ে একসময় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নামে একটিমাত্র আঞ্চলিক দল ছিল। এই দলের সঙ্গেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করেছিল সরকার। চুক্তির বিরোধিতা করে প্রথমে একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে ১৯৯৮ সালে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে নতুন দল করে। পরে জেএসএস ভেঙে জেএসএস (সংস্কারপন্থি) নামে ২০০৭ সালে আরেকটি দল হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক নামে নতুন দল হয়।
পার্বত্য চুক্তির এক বছরের মধ্যেই চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে ইউপিডিএফের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি ভেঙে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (লারমা) বা জেএসএস (লারমা) নামের নতুন দল। ২০১৭ সালে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর তপনজ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামের নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এই চারটি গ্রুপের বাইরেও আরও কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি)। এই দলের সদস্যদের অবস্থান বান্দরবানের গহিনে। ২০১৮ সালে এএলপি ভেঙে গঠিত হয় মগ পার্টি। তাদের অবস্থানও বান্দরবানে। তবে এই দুই দলের অবস্থান শুধু বান্দরবানে, রাঙামাটি কিংবা খাগড়াছড়িতে এদের কোনো তৎপরতা নেই।
কার শক্তি কোথায়?
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির যে চারটি গ্রুপ রয়েছে, সেগুলোর একেকটি শক্ত অবস্থান একেক জায়গায়। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের দুটি অংশের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা ও পাহাড়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের শক্ত অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে বান্দরবানে জেএসএসের দুইটি অংশের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। সেখানে জেএসএস শক্তিশালী। বান্দরবানের ইউপিডিএফের তৎপরতা নেই বললে চলে। আর রাঙামাটিতে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের চার পক্ষই শক্তিশালী।