আড়াই বছর আগে ঋণ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনেছিলেন মোফাজ্জল মিয়া। ১৪ জানুয়ারি সকালে আশুলিয়ার কাঁইচাবাড়ি এলাকা একটি সড়কের পাশে তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি নিহত মোফাজ্জলের অটোরিকশা, মোবাইল ফোন ও টাকা। আশুলিয়া থানা পুলিশ জানায়, ভোর রাতে মোফাজ্জল হোসেনকে হত্যার পর তার রিকশা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
নিহত মোফাজ্জলের ভায়রা ওসমান গণি বলেন, ‘ভোর ৪টা বাজে গাড়ি নিয়া বাইর হইয়া আর ফেরে নাই। আমার বোন জামাইয়ের শরীরে ওরা অনেক কষ্ট দিয়া মারছে। রড দিয়া মাথায় মারছে। এখন আমার বোনডার ছোট দুইডা পোলার কী হইব? আমরা গরীব মাইনসে কী কষ্ট কইরা রিকশাচালায়ও খাইতে পারমু না? কয়ডা টাকার জন্য ওরা মাইরা ফালাইব? আমরা এইটার কঠিন শাস্তি চাই।’
ঢাকার সাভারে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে বলে দাবি চালকদের। তবে গত কয়েক মাসে কী পরিমাণ হত্যা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে সেটি নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি পুলিশ।
তবে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাভারে গত মাসেই মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে রাতের আঁধারে চারটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এছাড়া গত তিন মাসে খুন হয়েছেন আরও পাঁচজন। চলন্তবাসে রাতভর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক তরুণী। এছাড়া গত ছয় মাসে সাভার ও আশুলিয়ায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অন্তত ১৫-২০টি অটোরিকশা খুইয়েছেন হতদরিদ্র চালকরা। ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ গেছে অন্তত পাঁচজনের।
রাত যত বাড়ে সাভারে ততই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে অপরাধীরা। মাঝে মাঝেই হত্যার পর ফেলে রেখে যাওয়া হয় জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত মরদেহ। অর্ধগলিত মরদেহের পরিচয় শনাক্ত নিয়েও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে পড়তে হয় বিপাকে। এছাড়া ছিনতাইকারীদের দ্বারা হত্যা কিংবা জখমের ঘটনা ঘটছে অহরহ।
ছিনতাইয়ের কবল থেকে বেঁচে ফেরা অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রশাসনের সাহায্য চাইছেন। এছাড়াও রাতে চলন্তবাসে ঘটেছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাও। অপরাধীরা যেন অনেকটাই নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছে এই জনপদকে।
সম্প্রতি ছিনতাইয়ের কবলে পড়া মাশরুফ হোসেন (Md Masruf Hossain) নামে এক ভুক্তভোগী ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি ও বিভিন্ন গ্রুপে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুটি ভয়ানক ঘটনা পোস্ট করেন।
এতে তিনি লেখেন, ‘ইদানিং সাভারের জাহাঙ্গীরনগর থেকে সিএনবি এর মাঝের পথটুকু ছিনতাইকারী ও ডাকাতির আখড়া হয়ে গেছে। স্থানীয় এবং পেশাদার ছিনতাইকারী ডাকাতরা এখানে গাছ ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে ধারাল অস্ত্র, ছুরি, চাপাতি, রামদা ও বন্দুকসহ পজিশন নিয়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। একাকি বা ধীরে চলে এমন গাড়ি বা রিকশা, অটোরিকশা, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ইত্যাদি দেখলেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সবকিছু কেড়ে নেয়। নিজের সবকিছু দিয়ে দিলেও অনেক সময় এদের ধারাল অস্ত্রের কোপের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। জনসম্মুখে পড়ে গেলে দ্রুত ডেইরি ফার্ম এর বাউন্ডারি টপকে কেটে পড়ে।’
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সিএন্ডবি থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছে সাভার হাইওয়ে পুলিশ। বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করার কথাও জানিয়েছেন তারা।
ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর উদ্ধার অটোরিকশাচালক রুবেল মিয়া। ছবি: নিউজবাংলা
১১ জুন সকালে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের হারুলিয়া চক এলাকায় কৃষি জমিতে রায়হান ও নাজমুল নামে দুই কিশোরের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
স্বজনদের দাবি, সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হয়ে তারা আর ফেরেনি। পুলিশও জানিয়েছে, রাতের কোনো এক সময়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
৯ জুন আশুলিয়ার সুবন্দি এলাকায় একটি বাঁশঝাড় থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই অবশ্য লাকী আক্তার নামে ওই তরুণীর পরিচয় নিশ্চিত হয় সংস্থাটি। এ ঘটনায়ও রাতের আঁধারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কথা জানায় আশুলিয়া থানা পুলিশ।
পরে নিহতের স্বামীকে র্যাব গ্রেপ্তার করলে আদালতে তিনি হত্যার কথা স্বীকার করেন বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এ ঘটনার দুই দিন আগে ৭ জুন সকালে আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকায় একটি বাড়ির বাউন্ডারির ভেতর পরিত্যক্ত জায়গা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বস্তাবন্দী মরদেহ পুলিশ উদ্ধার করে। এখনও তার পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও এই হত্যাকাণ্ডও রাতে ঘটেছে বলে ধারণা পুলিশের।
এছাড়া ১৬ মে রাতে সাভারের রাজাশন এলাকায় মোবাইলে গেম খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে আহত করার ২২ দিন পর তার মৃত্যু হয়।
২৩ মে আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় তালাবদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
২০ মে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাড়ইপাড়া এলাকায় ড্রেনের ভেতরে মেলে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির হাত-পা বাঁধা মরদেহ।
২৪ এপ্রিল রাতে সাভার মডেল থানার পৌর এলাকার আনন্দপুর মহল্লায় নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে এক যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়।
৩০ মার্চ রাতে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগড়াকান্দা এলাকায় মাথায় ইট দিয়ে থেঁতলে একজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার প্রায় সবগুলোরই রহস্য উদঘাটনের কথা নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
পথে নির্মমতার শিকার অটোরিকশা চালকরা বলছেন, গত প্রায় পাঁচ মাসে আশুলিয়ার বসুন্ধরা, পল্লীবিদ্যুৎ, পলাশবাড়ি, জামগড়া, বগাবাড়ি, নরসিংহপুর, জিরানী, নবীনগর, জাহাঙ্গীরনগর সোসাইটি ও সাভারের ভাকুর্তাসহ বেশ কিছু এলাকায় ছিনতাইকারী চক্রের কবলে পড়েছেন তারা। এক ডজনেরও বেশি ঘটনায় চালকদের অজ্ঞান ও ছুরিকাঘাত করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অটোরিকশা। ছিনতাইকারীদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ গেছে কয়েকজন রিকশাচালকের।
১১ জানুয়ারি নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার সড়কে ভোরবেলা অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় চাপাইন এলাকার রিকশা চালক রুবেল মিয়াকে। গলায় আঁচড়ের ক্ষত নিয়ে অসুস্থ্ ও সংজ্ঞাহীন রুবেল ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। চিনতে পারছিলেন না কাউকে। পরে তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে পাঠায় স্থানীয়রা। হাসপাতালে যাওয়ার আগে রুবেল জানান, তার রিকশাটি নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনার কয়েক দিন পর নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে পলাশবাড়ি এলাকায় ভোরে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন রিকশাচালক আপেল আলী। ওই সড়কে যেতেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা ছিনতাইকারীরা তার মাথায় আঘাত করে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় বলে জানান তিনি।
সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ করিম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিএন্ডবি থেকে জাহাঙ্গীরনগর জায়গাটা নিরিবিলি থাকে। এখানে মাদকাসক্ত গ্রুপ আছে অনেক। আমরা ধরার চেষ্টা করতেছি। দুই দিন ছয়জনকে ধরে মামলাও দিছি। বিএলআরইর ওয়ালটা বড় করার জন্য তাদেরকে বলেছি, যাতে ছিনতাইকারীরা পালায় যেতে না পারে। আমাদের টহল পুলিশ সবসময় কাজ করছে।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের প্রায় সবগুলো ঘটনাই ডিটেক্ট হয়েছে। আসামিরা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। আমাদের আটটা পেট্রোল টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে, যা পর্যাপ্ত। তবে ছিনতাইয়ের স্পট হাইওয়ে থানার আওতায়।’
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জোড়া খুনসহ হত্যাকাণ্ডের অপর ঘটনায় ঘটনায় আসামি ধরা পড়েছে। পুরোপুরি সব ডিটেক্ট হয়েছে। তবে রিসেন্টলি ছিনতাইয়ের মতো এরকম কোন ঘটনা আমার জানা নেই। এরকম ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিব। পাশাপাশি পেট্রোল টিমটা আরো জোরদার করব।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুল্লাহ হিল কাফির সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তারও কোনো উত্তর দেননি এই কর্মকর্তা।