সুনামগঞ্জের শাল্লার বাহাড়া ইউনিয়নের ভেড়াডহর গ্রামে একটি ঘর পেয়েছেন অলি বৈষ্ণব। ভূমিহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘরটি গত জানুয়ারিতে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। ছয় মাসেই সে ঘরে ফাটল ধরেছে; খুলে পড়ছে পলেস্তারা।
নিউজবাংলাকে অলি বৈষ্ণব বলেন, ‘আমার ঘরে ফাটল দেখা দিসে, খালি আমার ঘর না, ইলান আরও ১০টা ঘর ফাটল দিসে। ফাটলগুলোরে জোড়াতালি দিয়া প্লাস্টার করিয়া দেওয়া অয়। ইতা ঘরো আমরা থাকতাম কিলা, ঝড় তুফান দিলে তো ঘর ভাঙিয়া পড়ি যাইবো।’
সুনামগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৪ হাজার ২৬৬টির মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ১১ উপজেলার মধ্যে শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুরের ঘরগুলোতে এরই মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে।
এর মধ্যে আবার শাল্লার ভেড়াডহর, সেননগর, শান্তিপুর ও মুজিবনগর গ্রামের প্রায় ২৫টি ঘরে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। কয়েকটির রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ ভেঙে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
শাল্লার সেননগর গ্রামের কেনু মিয়া বলেন, ‘আমরা ঘরের দরজা-জানালা খুলিয়া যারগি। খালি আমার ঘর নায়, ইকানো খায়রুল মিয়া ও রুবেল মিয়ার ঘরও বড় ফাটল দিসে। আমার ঘরের দরজাটা ঠিক করছি, কিন্তু জানালাটা ঠিক করতে পারছি না।’
তাহিরপুরের মানিগাও গ্রামের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপকারভোগী বলেন, ‘বৃষ্টি আইলে ঘরো থাকতাম পারি না, ঘরের জানালাটা পর্যন্ত এরা লাগাইছে উল্টা… দুই দিন আগে কয়েকজন আইয়া আমরার কাম দেখিয়া গেছে, আমরার সমস্যার কথা কইছি তারা উল্টা আমরারের ভয় দেখাইছে।’
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পিঠাপসি ও ঘোড়াডুম্বুর গ্রামে প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ইউপি চেয়ারম্যান উপকারভোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুর মিয়া বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো তৈরিতে অনিয়ম হয়েছে, ঘরপ্রতি মেম্বার-চেয়ারম্যানরা টাকা তুলেছেন। আমি ফেসবুকেও লেখালেখি করছি। জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, কাজ এসে দেখে যান।’
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘যে ঘরগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সংস্কার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ফাটল দেখা দিলে আমরা দ্রুত মেরামত করব। এ ছাড়া ঘর নির্মাণে টাকা নেয়ার বিষয়টি আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে জানালে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’
শাল্লার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল মুক্তাদির হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্মাণকাজে কোনো গাফিলতি পাইনি। তবে যে ঘরগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে সেগুলো সংস্কার করা হচ্ছে।’
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে অসন্তোষ জানিয়েছেন উপকারভোগীরা। আবার নির্মাণের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বেশির ভাগ ঘরে দেয়া হয়নি বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। সেসব ঘরে এখনও উঠতে পারেননি উপকারভোগীরা।
আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে ঘর পরিদর্শন করেছি। বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও পরিদর্শন করেছেন। ঘর নির্মাণে কারও অনিয়ম আছে কি না তা এখনই বলা যাবে না। আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষ হলে বলতে পারব।’
এসব ঘর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ঘর তৈরিতে ইট, বালু ও সিমেন্ট থাকলেও রড ব্যবহার করা হয়নি। এ কারণে ঘরগুলো দুর্বল।
তারা বলেন, অনেকগুলো ঘর নিচু জায়গায় নির্মিত। এসব ঘরে রড দেয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু একেকটি ঘর নির্মাণের জন্য বাজেট ছিল মাত্র ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এই টাকায় রড ব্যবহার করে পুরো ঘর নির্মাণ সম্ভব নয়।
সিলেটে বিদ্যুৎ-পানি নেই, বন্যা আতঙ্ক
সিলেটের গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর গ্রামের বৃদ্ধা আয়েশা খাতুন নিজের ঘর পেয়ে ভেবেছিলেন, শেষ বয়সে হলেও মাথার ওপর ছাদ পেয়েছেন। কিন্তু সে ঘরে উঠে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাকে।
তিনি বলেন, ‘আগে থাকার কুনু জেগা আছিল না। কই থাকম তা ইটা নিয়া চিন্তা আছিল। অখন ঘর পাইলেও শান্তি নাই। ঢল নামলেউ ঘরো পানি উঠি যায়। ঘরোর আশপাশো পানি থাকে। এর লাগি অখন সব সময় ডরোর মাঝে থাকি, কুন সময় ঢল নামবো।’
তার মতো সেখানকার উপকারভোগীরা জানান, এখানকার নির্মিত সবগুলো ঘরেই ঢল নামলে পানি ওঠে। ঢালু জায়গায় বলে পানি ঘরে অনেকটা সময় আটকে থাকে।
সিলেট সদরের খাদিমনগর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন মখলিসুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ঝড়-তুফান শুরু হলেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। বাতাস শুরু হলে মনে হয় টিনের চাল উড়ে যাবে; পিলারগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। রডহীন পিলারগুলো জোরে বাতাস হলেই নড়ে ওঠে।’
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৩টি উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৪টি ঘর উপকারভোগীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। লক্ষ্য আছে ৪ হাজার ১৭৮টি ঘর তৈরির।
সিলেট সদরের কান্দিগাঁওয়ে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার আশ্রয়ণের বেশির ভাগ ঘর ফাঁকা। বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নেই বলে ছয় মাসেও ঘরে উঠেননি উপকারভোগীরা।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সিলেটের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, সংযোগ দিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পানির লাইনের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে। শিগগিরই এগুলো হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘সিলেটে এখনও কোনো ঘর ভেঙে যাওয়া বা নির্মাণকাজে অনিয়মের অভিযোগ পাইনি। তবু আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’
স্বল্প বাজেটে রডহীন ঘর নির্মাণের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আসলে আমার কিছু বলার নেই। ঘরগুলো তৈরির নির্মাণসামগ্রী এবং ব্যয় যারা নির্ধারণ করেছেন, তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার অর্জুন পাল বলেন, ‘এসব ঘর ভালো করে নির্মাণ করতে হলে অন্তত ৪ লাখ টাকার প্রয়োজন। এত কম বাজেটে ভালো ঘর নির্মাণ সম্ভব নয়। এ ছাড়া ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেটে রড ছাড়া ঘর নির্মাণের কথা তো ভাবাই যায় না। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’
বন্যার ভয় হবিগঞ্জে
হবিগঞ্জের প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১ হাজার ১৪২টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ঘর ভূমিহীন পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকিগুলো নির্মাণাধীন।
এর মধ্যে মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলার দুটি প্রকল্পের ঘর নিয়ে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।
চুনারুঘাটের ইকরতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭০টি ঘরের মধ্যে মাত্র ৩২টিতে বসবাস করছেন মানুষ। অন্যগুলোতে এখনও তালা ঝুলছে।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, যে জায়গায় ঘর দেয়া হয়েছে এর ১০ কিলোমিটারের ভেতরে কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। নেই বিদ্যুৎ ও পানি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে রাস্তাঘাট ভালো না, মানুষের যাতায়াত নেই। যে কারণে কাজও নেই। ৭৪টি পরিবারের জন্য মাত্র ৪টি টিউবওয়েল দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। বলতে গেলে ঘর ছাড়া এখানে মানুষের জন্য আর কিছুই নেই।’
চুনারুঘাটের ইউএনও সত্যজিৎ রায় দাশ বলেন, ‘সেখানকার সকল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেখানে আরও কয়েকটি টিউবওয়েল বসানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া হচ্ছে।’
জেলার মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা ইউনিয়নের রূপনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২৭টি ভূমিহীন পরিবার বছরের শুরুতে যখন ঘরে ওঠেন, তখন তারা ছিলেন আনন্দে আত্মহারা। সে খুশি ছয় মাসেই মলিন হয়েছে।
রাস্তা থেকে প্রায় ৫ থেকে ৬ ফুট নিচু জায়গায় মাটি ভরাট না করেই বানানো হয়েছে ঘরগুলো। আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ঘরে ঢুকে পড়ে ময়লা পানি।
অভিযোগ উঠেছে, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসনুভা নাশতারান স্থানীয়দের মতামত উপেক্ষা করে নিচু জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। এ অভিযোগে সম্প্রতি তাসনুভাকে শোকজও করেছে মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে মাধবপুরের ইউএনও শেখ মাঈনুল ইসলাম মঈন বলেন, ‘প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ লাঘবে মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে একটি প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে।’
হবিগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও গৃহনির্মাণসংক্রান্ত কমিটির সদস্য তওহীদ আহমদ সজল বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা রূপনগর আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করে এসেছি। সেখানে বৃষ্টির পানি জমেছিল। আর যেন পানি জমতে না পারে সে জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
‘এ ছাড়া চুনারুঘাটের ইকরতলী প্রকল্পের অধিকাংশ পরিবারই এখন চলে আসছেন। তবে সেখানে বসবাস করা পরিবারগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করার কারণে ঘরগুলো তালাবদ্ধ করে নিজ নিজ কাজে চলে গেছেন।’
বড়লেখায় ৫ মাসেও ব্যবস্থা হয়নি পানি ও বিদ্যুতের
মৌলভীবাজারের বড়লেখায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৫০টি ঘরে উদ্বোধনের পাঁচ মাসেও যায়নি পানি ও বিদ্যুৎ। এ কারণে এখনও ৩৪টি পরিবার ঘরে ওঠেনি। আর যারা উঠেছেন, তারা পানি ও বিদ্যুতের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমাজ উদ্দিন সরদার বলেন, ‘৫০ ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে ইউএনওর কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। স্ব স্ব ইউপি চেয়ারম্যানদের ঘরগুলোতে ওয়্যারিং কাজ করানোর কথা।
‘কিন্তু ওয়্যারিং কাজ না করায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া যায়নি। তবে বুধবার (৭ জুলাই) পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে আমাদের কাছে পত্র এসেছে। ঘরগুলোতে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ নিজ খরচে ওয়্যারিংসহ যাবতীয় কাজ করে দেবে। যেসব ঘর মেইন লাইন থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে আছে, সেগুলোতে দ্রুত সংযোগ দেয়া হবে। অন্যগুলোতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন জানান, উপহারের ঘরগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এ কাজে সময় লাগছে। এক সপ্তাহের মধ্যে নলকূপ স্থাপন করে উপকারভোগীদের হস্তান্তর করা হবে।
বড়লেখার ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। যোগদানের পর প্রথম মাসিক সমন্বয় সভায় ঘরগুলোতে পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএমকে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বলা হয়েছিল… ডিজিএম জানিয়েছেন, ১৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হবে। ঘরগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজও চলছে।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরনের গাফিলতি গ্রহণযোগ্য নয়। তা সফলভাবে বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’