‘জাটকা অভিযানের পরেত্তনে নৌকা, জাল লইয়া গাঙ্গো যাই, জাল হালাই। কিন্তু মাছ কই? যেমন জাল হালাই, টানার পরেও হেমন খালিই ওডে! ইলিশ তো দূরে থাহোক, গাঙ্গো কোনো মাছই নাই। ভাইগ্য বালা থাকলে জালে দুই-চারইটা যাঅই ওডে, হেই দিয়া আমাগো নৌকার খরচের টেহাই অয় না, চাউল, ডাইল কিনমু কেমনে? আমগো সংসারের চাকা আর চলে না।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুর শহরের গুয়াখোলা এলাকার জেলে বিনয় বর্মণ।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, জাটকা রক্ষা অভিযানে দুই মাস বেকার সময় কেটেছে। সে সময় দেনা করে সংসার চালিয়েছেন। ভেবেছিলেন মৌসুম এলে মাছ ধরে দেনা শোধ করবেন। এখন মৌসুম এলেও মিলছে না ইলিশ। তাতে সংসার চালানোই কঠিন, দেনা শোধের তো সুযোগই হচ্ছে না।
বিনয়ের মতো দুর্দশা জেলার নিবন্ধিত প্রায় অর্ধলাখ জেলের। সারা দিন জাল ফেলেও কাঙ্ক্ষিত মাছ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তারা। অর্থসংকটে তারা হতাশায় ভুগছেন।
তাদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞার সময় অনেক জেলে নজরদারি এড়িয়ে জাটকা ধরেছেন। এ কারণে মৌসুমে নেই পর্যাপ্ত ইলিশ।
শহরের আরেক জেলে আব্দুল মালেক বলেন, ‘ইলিশের পোনা জাটকা রক্ষা অভয়াশ্রমে প্রশাসনের ঠিকমতো তদারকি না থাহনে অনেক অসাধু জাউল্লা সমানে জাটকা ধরচে। তাই অহন মৌসুমেও আমরা মাছ পাই না। আমরা অভিযানের সময় গাঙ্গে মাছ ধরি নাই। ধারদেনা কইরা চলছি। অহন মাছ না পাওনে পরিবার নিয়া কষ্টে দিন যাইতেছে।’
হাইমচর উপজেলার কাটাখালী এলাকার জেলে ফজল গাজী ও তারেক হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, নৌকা ও জাল নিয়ে মাছ ধরতে নামলে প্রতিবার খরচ হয় হাজার থেকে ১২০০ টাকা। সেখানে এখন এমন পরিস্থিতি যে, সারা দিন মাছ ধরে যে পরিমাণ টাকা ওঠে, তাতে একেকজনের ভাগে পড়ে দুই থেকে তিন শ টাকা।
ফজল বলেন, ‘এই টেহা দিয়ে চাউল কিনলে ডাইল কিনা যায় না। তরিতরকারি কিনমু কেমনে? সামনে ঈদ আইতেছে, বৌ-পোলাপাইনেরে যে কিছু কিন্না দিমু হেই উপাই নাই।’
জেলেরা মাছ না পাওয়ায় ব্যস্ততা নেই নদীপাড়ের আড়তগুলোতে। মাছ না থাকায় অলস সময় কাটছে আড়তদারদের। তাদের চোখেমুখে লোকসানের শঙ্কা।
সদরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের মেঘনা নদীর পাড়ের দুই আড়তদার জানান, জেলেদের লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে এখন দিশেহারা তারা। সারা দিনে দুই বা তিন হাজার টাকার মাছও আসে না আড়তে। মাছ বিক্রি নেই বলে কমিশন নেই। সব মিলিয়ে জেলেদের মতো তারাও চোখে যেন শর্ষে ফুল দেখছেন।
বড়স্টেশন ঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী বিপ্লব খান বলেন, ‘বর্তমানে ঘাটে ৫০ থেকে ৬০ মণ ইলিশ আসে, বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে ৫০০ থেকে ৬০০ মণ ইলিশ আসত।’
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত বলেন, ‘এখন ইলিশের মৌসুম চললেও স্থানীয় নদীতে ইলিশ নেই। জেলেরা ইলিশ না পাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যতম বড় ইলিশের বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটে।
‘মৌসুমে এই বাজারে ৮-১০ হাজার মণ ইলিশ সরবরাহ হলেও বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১১০০ থেকে ১৫০০ মণ। এসব ইলিশ ভোলা, বরগুনা, হাতিয়া, সন্দ্বীপসহ সমুদ্রাঞ্চলের মাছ। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ ৫০ মণও সরবরাহ হয় না। অথচ সারা দেশে চাঁদপুরের ইলিশের অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মাছ না থাকায় আমরা বিক্রি করতে পারছি না। এতে করে ঋণ করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ‘এ বছর বৈশাখ মাসে বৃষ্টি কম হওয়ায় নদীতে পানির স্রোত কম ছিল। তা ছাড়া দিন দিন নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, নদীতে ডুবোচর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
‘তবে জেলেদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশা করছি, জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় অমাবস্যা-পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে চলতি মাসের শেষ দিক থেকে নদীতে ইলিশ উঠে আসবে। অচিরেই ইলিশ বৃদ্ধি পাবে নদীতে। রুপালি ইলিশে হাসি ফুটবে জেলেদের মুখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। আশা করছি, সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে রেকর্ড পৌনে ছয় লাখ টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’