সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর এক দশকে কুমিল্লাবাসী কী পেল, সেই হিসাব মিলছে না। জলাবদ্ধতা, যানজটসহ নাগরিক নানা সমস্যার সমাধানে দৃশ্যমান উন্নতি না দেখে নাগরিকদের মধ্যে প্রশ্ন বড় হয়েছে, ‘কী পেলাম এক দশকে।’
২০১১ সালে ১০ জুলাই বাংলাদেশ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক অধ্যাদেশে কুমিল্লা পৌরসভা ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ পৌরসভাকে এক করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয়। ৫৩ দশমিক ০৪ বর্গ কিলোমিটারের করপোরেশনটির রয়েছে ২৭ ওয়ার্ড; পাঁচ লক্ষাধিক লোকের বসবাস এখানে।
সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়া নিয়ে সে সময় উচ্ছ্বাস ছিল নগরবাসীর মনে। তবে এক দশক পূর্তির দিন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিয়ে নগরবাসী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করছেন নেতিবাচক মূল্যায়ন।
সিটি মেয়র নিজেই বলেছেন অনেক কিছু না পাওয়ার আক্ষেপের কথা। বলেছেন, যে জনবল আছে, সেটি দিয়ে উন্নত নাগরিক সেবা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বাজেট স্বল্পতার বিষয়টি সামনে এসেছেন তিনি।
এই এক দশকে নগরীতে উঠেছে সুউচ্চ দালান। নগরীর শাসনগাছা থেকে পুলিশ লাইন, ঝাউতলা, কান্দিরপাড়, টমসমব্রিজ- সবগুলো এলাকায় এখন বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি।
দখল হয়ে গেছে পানি নিষ্কাষণের খাল। কান্দি খালের দখলদার হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির পাশাপাশি উঠে এসেছে চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও।
সিটি করপোরেশনের কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। ঠিকাদাররা ইচ্ছে মতে কাজ করেন। বিল তোলেন, সমস্যা আর শেষ হয় না।
পার্কিং নেই বলে যানজট শহরের এক নিয়মিত চিত্র। অন্য জেলা সদর থেকে কেউ আসলেই বলেন অপরিকল্পিত নগরী।
বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় সড়ক। ছবি:নিউজবাংলা
কুমিল্লার ‘সচেতন নাগরিক কমিটি’র সভাপতি বদরুল হুদা জেনু নিউজবাংলাকে বলেন, ২০১১ সালে ১০ জুলাই যখন সিটি করপোরেশন হয় আমরা নগরবাসী আনন্দিত হয়েছিলাম। তবে আমাদের আনন্দ এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, সড়ক দখল করে অপরিকল্পিত নগরায়ন করা হয়েছে। নগরীর কান্দিরপাড়, ঝাউতলা ও রেসকোর্সে বেশ কিছু ভবন সড়কের উপরে গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে এখন কুমিল্লা সিটি করপেরেশনকে এখন ইটের বস্তি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
‘প্রতি বছরই শুনেছি পরিকল্পিত নগরায়ন করার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাস্তবে আমরা তার বাস্তবায়ন দেখি নাই। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে কুমিল্লা শহর।’
সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো জলাবদ্ধতা দূরীকরণ। তবে এ ক্ষেত্রে সাফল্যের কথা কেউ বলতে পারবে না। বরং দিনকে দিন অবনতি হয়েছে পরিস্থিতির।
গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ‘কুমিল্লা শহরে জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে ২০০১-২০০২ সালের দিকে। তখন কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন কামাল চৌধুরী। বর্তমানে এটি চরম আকার ধারণ করেছে। চলতি বছর বর্ষায় আমার বাসায় পানি উঠেছে। আমি আমার এত বেশি জলাবদ্ধতা কখনও দেখি নাই। অবশ্যই এ জন্য মেয়রকে দায় নিতে হবে। গত এক দশকে তিনি নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমাধান করতে পারেননি।’
দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ছবি: নিউজবাংলা
তবে নাগরিক সমস্যাগুলোর জন্য শুধু মেয়রকে দায়ী করতে নারাজ কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুল। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি নগরের পানি নিষ্কাশনের খাল দখল করেছে নগরবাসী। তাহলে পানি সরবে কীভাবে? গত ১০ বছরে নগরীর সড়ক ও ফুটপাতের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। সিটি করপোরেশনের বাজেট ও জনবল সংকটও আমার নজরে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়রের অবশ্যই ব্যর্থতা রয়েছে। তবে আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। এখন সুপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।’
মেয়র নিজেই জানালেন, করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগে কোনো চিকিৎসক নেই। করোনার এই সময়ে তাই স্থানীয় সরকারের এই বিভাগটি থেকে কোনো সেবা মিলছে না। সব মিলিয়ে ৭/৮ জন লোক দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ।
মেয়র কী বলছেন
সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কুই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন হয়েছে ২০১১ সালে। নির্বাচন ও শপথ গ্রহণ করার পরে ২০১২ সালের ৩০ মার্চ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করি। তারপর যে বাজেট ও লোকবল দিয়ে উন্নয়ন কাজ শুরু করি তা যথেষ্ট ছিল না। ২০১৪ সালের শেষে মূলত সিটি করপোরেশনের কাজ শুরু বলা যায়।’
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে এই ৯ বছরে ১৪৫ কোটি টাকা একনেকে পাস করেছে। যার মধ্যে ১০ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে আনতে হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছরে ৮ কোটি টাকা করে দেয়া হয় চারটি কিস্তিতে। এ কম বাজেটে উন্নয়ন কাজ চলমান রাখা দুঃসাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর ১২ শ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এই বরাদ্দে আড়াইশ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। যার জন্য এ টাকা আনতে আমি নারাজ।’
জলাবদ্ধতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পানি নিষ্কাশন হয় কান্দি খাল দিয়ে। নগরীর টমছমব্রিজ থেকে নোয়াগাঁও চৌমুহনী পর্যন্ত খাল ৪০ জনের দখলে আছে। এর মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, বন বিভাগ ও শাকতলা স্কুলও আছে।
‘পূর্বে যেখানে খাল ছিলো কুমিল্লা-নোয়াখালী ফোরলেনের কাজের কারণে অর্ধেক খাল ভরাট করা হয়েছে যা শহরে জলাবদ্ধাতার বড় কারণ। এ খাল উদ্ধারের জন্য স্থানীয় এমপি মহোদয়ের সাথে আলাপ হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় আমরা কান্দিখাল দখলমুক্তের পর আরও সম্প্রসারিত করব। খালের দুই পাশে ওয়াল তৈরি করব।’
গত বছর সিটিতে জলাবদ্ধতা ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু সমস্যা দেখা দিয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধান করতে। যেহেতু পানি নিষ্কাশনের ৪ ভাগের ৩ ভাগ শেষ হয়েছে। আগামী বছর থেকে আর জলাবদ্ধতা হবে না।’
যানজট নিরসনে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে মেয়র সাক্কু বলেন, ‘ঈদের পরেই টাউন সার্ভিস শুরু হবে। আশা করি তখন থেকে আর যানজট সৃষ্টি হবে না।’
অপরিকল্পিত ভবনের কী সমাধান হবে- এই প্রশ্নে মেয়র বলেন, ‘আমরা অবৈধ ভবন মালিকদেরকে চিঠি দিয়েছি। বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন ভেঙেছি। অভিযান চলবে।’
লোকবলের স্বল্পতার কথা তুলেছেন মেয়র। বলেন, তাদের ১২ শ লোকবল প্রয়োজন। কিন্তু আছে কেবল ৮৪ জন স্থায়ী এবং আট থেকে নয়শ জন মাস্টার রোলের কর্মী।
তিনি বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে জানিয়েছি। এখন তারা ৫২০ টি পদে লোক নিয়োগের জন্য অনুমোদন করেছেন।’
মেয়র সাক্কু বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের বহু কাজ বাকি, লোকবল নিয়োগ ও বাজেট বাড়লে নাগরিক সমস্যা আর থাকবে না। আমরা সে লক্ষ্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’