সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে গত ২২ জুন জামালপুরে দাদাবাড়ি যাওয়ার পথে দিনদুপুরে নিখোঁজ হন সাব্বির আহম্মেদ (২৪) নামের এক যুবক, যার খোঁজ আজও পাননি স্বজনরা।
সাব্বিরের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় এনায়েতপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়, র্যাব-১৪ কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও করা হয়। এ ছাড়া তাকে অপহরণের অভিযোগ এনে মামলা (পিটিশন নং-০৮/২১) করা হয় জেলা জজ আদালতে। আদালত ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে পিবিআইকে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইলের সরকারি করটিয়া সা’দত কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সাব্বির অপহৃত হননি। প্রতারক চক্র বিশেষ প্রযুক্তির সহাতায় তার ফোন নম্বর ক্লোন করে সেই নম্বর দিয়ে স্ত্রীর কাছে মুক্তিপণ দাবি করেছিল। মুক্তিপণ বাবদ ৩০ হাজার টাকাও নেয় তারা। এই প্রতারকদের সঙ্গে নিখোঁজ সাব্বিরের কোনো সম্পর্ক নেই।
থানা-পুলিশ, র্যাবের কাছে করা অভিযোগ ও মামলার এজাহারের তথ্যানুযায়ী, গত ২২ জুন দুপুর ২টার দিকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর কেজির মোড় থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়েন সাব্বির। সেখান থেকে জেলার কড্ডার মোড়ে গিয়ে জামালপুরগামী বাসে দাদাবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে সাব্বিরের মোবাইল নম্বরে ফোন করে সেটি বন্ধ পান তার স্ত্রী আনিকা।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘উনি অটোরিকশা নিয়ে কড্ডার মোড় পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন কি না কিংবা বাসে উঠেছিলেন কি না, সেসবের কোনো তথ্য জানতে পারি নাই। কারণ বাসা থেকে বের হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর তাকে ফোন করলে বন্ধ পাই। জামালপুরে দাদাবাড়ি ও বিভিন্ন স্বজনের কাছে ফোন করা হয়। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এরপর সবাই মিলে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাইনি। ঘটনার দুই দিন পর ২৪ জুন এনায়েতপুর থানায় জিডি করি।’
আনিকা আরও বলেন, ‘জিডির পর আমার স্বামীর ব্যবহৃত ফোন নম্বর দিয়ে আমার ফোনে ফোন করা হয়। মুক্তিপণের জন্য ৩০ হাজার টাকা চায়। সেই টাকা রকেটের মাধ্যমে দেয়ার পর তাদের ফোন বন্ধ হয়ে যায়।’
সাব্বিরের বড় ভাই মো. শাহেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার পর প্রথম দুই দিন তেমন গুরুত্ব দিই নাই। মনে হয়েছে, মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই ফোন বন্ধ। তৃতীয় দিনে মনে হয়েছে, মলম বা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে কোথাও পড়ে আছে। চতুর্থ দিনে অপহরণকারীরা মুক্তিপণ চাইলে মনে হয় অপহরণের শিকার হয়েছে।
‘পরবর্তী সময়ে র্যাবের কাছে গেলে জিডিমূলে থানায় মামলা করতে বলা হয়। থানায় মামলা না নিলে কোর্টে মামলা করি। সেই মামলার কপি র্যাব ও পিবিআইকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো কেউই ভাইয়ের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। উল্টো পুলিশ ফোন করে জানতে চায় কোনো তথ্য পেয়েছি কি না।’
স্বজন ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার উত্তর শ্রীবরদী গ্রামের লোকমান উদ্দিনের প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে। তাদের মধ্যে সাব্বির মেজো। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর লোকমান উদ্দীন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
টাঙ্গাইলের সরকারি করটিয়া সা’দত কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সাব্বির আহম্মেদ প্রায় আট মাস আগে এনায়েতপুরে বিয়ে করেন। করোনায় কলেজ বন্ধ থাকায় করটিয়া হাটে কিছুদিন বোরকা বিক্রি করেন। এরপর জামালপুরে দাদাবাড়িতে তার এক চাচার কারখানায় কাজ করছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সাব্বিরকে সবাই খুঁজছেন। তার সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দ্বন্দ্ব নেই।
সহপাঠীরা নিউজবাংলাকে জানান, সাব্বির কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। মাঝেমধ্যে ‘দাওয়াতের’ কাজ করতেন। তবে সেটা তাবলিগ জামাত কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি তারা।
সাব্বিরের মোবাইল নম্বর দিয়ে মুক্তিপণ দাবি!
স্বজনরা জানান, সাব্বির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ২৪ জুন জিডি করা হয়। পরদিন ২৬ জুন আনুমানিক রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাব্বিরের স্ত্রী আনিকার ফোনে ফোন আসে সাব্বিরেরই দুটি নম্বর থেকে। অপর প্রান্ত থেকে মুক্তিপণ হিসাবে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। বলা হয়, সেই টাকা পাওয়ার পর সাব্বিরকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু টাকা দেয়া হলেও সাব্বিরকে পাওয়া যায়নি।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ওসি মো. আনিসুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, সাব্বিরকে উদ্ধার করার জন্য প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে। ঘটনার ছায়া তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
সিরাজগঞ্জের পিবিআই পুলিশ সুপার রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিখোঁজ সাব্বিরের স্ত্রীর করা মামলার কাগজপত্র এখনও আমাদের কাছে আসেনি। তবে কাগজপত্র আসার আগেই আমরা তদন্ত শুরু করে দিয়েছি। প্রযুক্তিগত সহায়তায় সাব্বিরকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এরপর ম্যানুয়ালি চেষ্টা করব।’
তিনি বলেন, ‘স্বজনদের কাছে নিখোঁজ সাব্বিরের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েই মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল। সেসব নম্বর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতারক চক্র বিশেষ প্রযুক্তির সহায়তায় নিখোঁজ ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে সেই নম্বর দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা দাবি করেছিল। আমাদের তদন্তে মনে হয়েছে, এটা প্রতারক চক্রের কাজ। এই প্রতারকদের সঙ্গে নিখোঁজ সাব্বিরের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।’