হাসপাতালের স্ট্রেচারে চাদরে মোড়ানো একটি নিথর দেহ। তার পাশেই অঝোরে কাঁদছে ছোট্ট একটি শিশু।
কাঁদতে কাঁদতেই স্ট্রেচারে থাকা মানুষটির চোখেমুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। আর বলছে, ‘আমার আব্বু কথা বলে না কেন, আব্বুকে কেউ জাগিয়ে তুলো। বাবা কি মারা গেছে, আর কি কথা বলবে না।’
ঘটনাটি সোমবার রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের। এ নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
স্ট্রেচারে থাকা মরদেহটি নওগাঁর পোরশা উপজেলার কলোনিপাড়ার মুজিবর রহমান। শ্বাসকষ্টে থাকা মুজিবরকে সোমবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে চিকিৎসক দেখার আগেই তার মৃত্যু হয়। আর শিশুটি তার মেয়ে মরিয়ম খাতুন।
স্থানীয়রা জানান, মুজিবর পেশায় ছিলেন ফেরিওয়ালা। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। সব চাহিদা মেটাতে না পারলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না তার পরিবারে।
মুজিবরের স্ত্রী তানজিলা খাতুন জানান, ৪-৫ দিন আগে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার স্বামীর। প্রথমে মুজিবর মনে করেছিলেন, হয়তো তীব্র গরমে শরীর খারাপ হয়েছে। তবে গত রোববার সন্ধ্যায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে স্থানীয় পোরশা উপজেলা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অক্সিজেন ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।তিনি আরও জানান, সোমবার দুপুরে মুজিবরের অক্সিজেন লেভেল আরও কমে গেলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন চিকিৎসক। সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর স্ট্রেচারে করে জরুরি বিভাগে নেয়ার সময়ই তিনি বুকে অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করেন।
ছটফট করতে করতে চিকিৎসক দেখার আগেই নিস্তেজ হয়ে যান মুজিবর। পরে চিকিৎসক এসে জানান, কিছুক্ষণ আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
তারা যখন হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মুজিবরের মরদেহ বাড়িতে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বাবার পাশে তাদের মেয়ে মরিয়ম কাঁদছিল বলে জানান তিনি।
এদিকে মুজিবরকে সোমবার রাতেই পোরশায় কলোনিপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তবে থামেনি তার পরিবারের শোকের মাতম। বিশেষ করে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না মরিয়মের কান্না।
মঙ্গলবার দুপুরে মুজিবরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সবাই দিশেহারা।
মুজিবরের ছোট্ট মেয়ে মরিয়ম এ সময় কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আব্বু আমাকে খুব আদর করত। কাজ থেকে বাড়িতে ফিরলে দোকান থেকে আমার জন্য অনেকগুলো খাবার আনত।
‘বাড়িতে আসার পর আব্বু আগে আমাকে কোলে নিত, আদর করত, কপালে চুমু খেত। এখন আব্বু নাই, কে আমাকে আদর করে মরিয়ম মা বলে ডাকবে।’
মুজিবরের স্ত্রী বলেন, ‘আমার ছোট্ট মেয়েটা এখনও মেনে নিতে পারছে না, তার বাবা নেই। ওর কান্না কিছুতেই থামাতে পারছি না। আমাদের ওপর থেকে বড় ছাতাই তো চলে গেছে, এখন কেমনে কাটাব সামনের দিনগুলো।’
মরিয়মের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয় প্রশাসন
মুজিবরের করোনা হয়েছিল কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা নাকি অন্য কিছু হয়েছিল তা আমরা জানি না। সেখানকার ডাক্তাররাও কোনো নমুনা সংগ্রহ করেনি। শুধু আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদের মরদেহ নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে।’
পোরশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মাহবুব হাসান জানান, বুকে তীব্র ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোববার রাতে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মুজিবরকে। এরপর তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়।
সোমবার দুপুরের দিকে অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পরিবার রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে তার মৃত্যু হয়।
মুজিবর করোনা আক্রান্ত ছিলেন কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে করোনার লক্ষণ তার দেহে ছিল। আর যেহেতু রাজশাহীতে মারা গেছেন, সে ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত কি না সেটা রাজশাহী মেডিক্যালই নিশ্চিত করতে পারবে।
‘গতকাল (সোমবার) রাতেই পরিবারের সদস্যরা তাকে দাফন করেছেন।’
পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজুমল হামিদ রেজা বলেন, ‘বাবার মরদেহের পাশে ছোট্ট মেয়ের কান্নার ভিডিওটি দেখার পর আমারও খুবই খারাপ লেগেছে। নিজের চোখের পানি আমিও ধরে রাখতে পারি নাই। ঘটনাটি আসলে খুবই বেদনাদায়ক।’
তিনি জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সোমবার মুজিবরের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। আগামীতে উপজেলা প্রশাসন থেকে আরও সহায়তা দেয়া হবে।