শাটডাউনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি আমের দাম অবিশ্বাস্য রকম কমে গেছে। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে এই আম। একটু ভালো মানের হলে দর ৯০০ টাকা। গত বছর এই আম বিক্রি হয়েছে ১৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে।
আম এখন চাষ হয় উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি খুলনা বিভাগেও। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের কদরই আলাদা। অন্য জেলার চেয়ে এখানকার আমের দামও থাকে বেশি।
চলতি বছর এই দাম অনেকটাই কম। এখন বাজারে প্রতি মণ আম্রপালি বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা মণ দরে। ল্যাংড়ার দাম মণে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
মৌসুমের শেষ দিকে খিরসাপাত মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২৮০০ টাকায়। গত বছর এই সময়ে এই আমের দাম ছিল ৪ হাজার টাকার মতো।
শিবগঞ্জ উপজেলার চককির্তী গ্রামের আম ব্যবসায়ী এজাবুল মণ্ডল অন্তত ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসায় যুক্ত। এবার তার বিনিয়োগ ২০ লাখ টাকা। এই টাকা উঠবে কি না, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
তিনি বলেন, ‘১৬ লাখ টাকা দিয়্যা বাগান কিন্যাছি, আর ৪ লাখ টাকা খরচ। ১৫টা লেবার আছে, ৪টা ভ্যান আছে। ম্যালা খরচ। খরচটাই বেশি হয়্যা গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের কদর দেশে সবচেয়ে বেশি হলেও এবার করোনা সংক্রমণের মধ্যে দাম কম। ছবি: নিউজবাংলা‘৪ হাজার টাকা মণ আম বেচলেও যে খরচ, ২০০ টাকা মণ আম বেচলেও সেই খরচ। এবার বাজারে যে দামে আম বেচছি তাতে লেবার আর ভ্যান খরচই উঠে না।’
বাজারের আমের যে দর, তাতে প্রায় ১০ লাখ টাকা উঠে আসতে পারে বলে তার ধারণা।
এজাবুল মণ্ডলের মতো অন্য ব্যবসায়ীও আমের দর নিয়ে হতাশ।
এ বছর মৌসুমের শুরুতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। সংক্রমণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন টানা ১৪ দিনের বিধিনিষেধ ঘোষণা করে।
আমকেন্দ্রিক সব কার্যক্রম বিধিনিষেধের বাইরে ছিল তখন। চলমান শাটডাউনেও আমকে রাখা হয়েছে বিধিনিষেধের বাইরে। তবু এই বিষয়টি আম বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এখানকার অর্থনীতির একটা বড় অংশজুড়েই আছে এ মৌসুমি ফল। এই কয় মাসে এখানে কয়েক হাজার কোটির টাকার বেশি বাণিজ্যকে ঘিরেই চলে অনেকের জীবিকাও।
জেলায় আম বাগানের আয়তন ৩৪ হাজার ৭৩৮ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ। এ বছর কৃষি বিভাগ আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল আড়াই লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এটিও দরপতনের একটা কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন কানসাট বিশ্বনাথপুরের আম ব্যবসায়ী মাইনুল ইসলাম।
অনেকেই বাগান কিনে লোকসানের মুখে পড়েছেন আমের দাম নিয়ে। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘এবার আমের উৎপাদন বেশি। সারা বাংলাদেশেই আমের উৎপাদন বেশি। এ জন্যই বাজারে আমের দামটা কম।’
আরেক আম ব্যবসায়ী সুকুমার প্রামাণিক বলেন, ‘এ বছর আম হয়েছে গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি।’
বিধিনিষেধ থাকার কারণে আমের বেচাকেনা দেশের বড় শহরগুলোতে জমে উঠতে পারেনি। এটিও দরপতনের বড় কারণ বলছেন কানসাট আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু।
তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের কেনাবেচায় বিধিনিষেধ নাই। কিন্ত যে আমটা ঢাকা বা অন্য জেলায় পাঠানো হচ্ছে, সেখানে তো আমটা কিনতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে যেভাবে আম বিক্রি হতো, লকডাউনের কারণে সেটা তো করা যাচ্ছে না।’
কানসাট বাজারের আম ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, ‘মানুষের পকেটে টাকা থাকলে তো আম খাবে। মানুষের পকেটে টাকা নাই।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলছেন, আমের বাড়তি উৎপাদনকে কাজে লাগাতে আম থেকে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরির পরিসর বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের দাম কম হওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় দিন পার করছেন ব্যবসায়ীরা। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘আমের জুস তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে অনেক নতুন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন। তাদের কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘গত বছর ৬৬ মেট্রিক টন আম বিভিন্ন দেশে গিয়েছিল। এ বছরও বিদেশে আম যাচ্ছে।
‘বিদেশে আম রপ্তানি বাড়াতেও কাজ করছে কৃষি বিভাগ, যাতে আমের নায্যমূল্য নিশ্চিত হয়।’
বাংলাদেশ ম্যাঙ্গো প্রডিউসার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলন, ‘এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে।
‘লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধের কারণে এবার সারা দেশ থেকে আমের পাইকারি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা আসতে পারেনি, যার প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে।’