পাবনায় তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনা ও ঋণ সহায়তার পাশাপাশি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়েছিল সরকার। তবে ক্ষুদ্র তাঁতিদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে।
জেলার পাঁচটি তাঁতি সমিতি এ সুবিধার আওতায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করলেও কিছুই পাননি প্রান্তিক তাঁতিরা।
করোনা পরিস্থিতিতে টানা লোকসানের কারণে মহাজনি ঋণ ও এনজিওর টাকা নিয়ে পৈতৃক ব্যবসা ধরে রাখতে গিয়ে যেখানে তাঁতিরা দিশেহারা, সেখানে তাদের দেয়া সহায়তায় চলছে হরিলুট।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫১টি তাঁতি সমিতির নামে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয় পাবনার পাঁচটি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে।
সমিতিগুলো হলো গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড, গয়েশপুর ৩ নম্বর, আতাইকুলা ৬ নম্বর ওয়ার্ড, দোগাছি ৩ নম্বর ওয়ার্ড ও একদন্ত ইউনিয়ন ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি।
এর মধ্যে তিনটি সমিতির নামে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামালের কিছুই পাননি তাঁতিরা। দুটিতে লভ্যাংশের নামে নামমাত্র টাকা দেয়া হয়েছে সদস্যদের।
অথচ আমদানি-রপ্তানি বিভাগের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, চারটি শর্তে তাঁতি সমিতি শুল্কমুক্ত এ সুবিধা পাবে। এর প্রধান শর্তই হলো শুল্কমুক্ত কাঁচামাল সমিতির তাঁতে ব্যবহার করতে হবে। কোথাও বিক্রি বা হাতবদল করা যাবে না।
নিজেদের নামে আসা প্রায় ১০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত কাঁচামাল না পেয়ে গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড তাঁতি সমিতির মানববন্ধন
পাবনার সমিতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে গয়েশপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। কাঁচামাল না দিয়ে সমিতি থেকে প্রত্যেককে এক হাজার টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদস্যরা।
সমিতিটির সভাপতি আয়ুব হোসেনের দাবি, শুল্ক ছাড়া কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আমদানির সময় ও অর্থ কোনোটাই নেই প্রান্তিক তাঁতিদের। সাঁথিয়ার একজন ব্যবসায়ী তাকে এলসির মাধ্যমে আমদানির কথা বলেন। তাঁতিদের লাভের বিষয়টি চিন্তা করে তিনি তার কথায় রাজি হয়ে যান।
তিনি বলেন, ‘সেই ব্যবসায়ী আমদানির পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে লভ্যাংশ হিসেবে ছয় লাখ টাকা দেয়। সে টাকা আমি সমিতির ৫৫৮ জন সদস্যের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করোনাকালীন সহায়তা হিসেবে দিয়েছি।’
তবে ওই আমদানিকারকের নাম বলতে রাজি হননি তিনি।
এ সুবিধায় ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার সুতা, সোডিয়াম সালফাইডসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানির অনুমতি পায় গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। প্রান্তিক তাঁতিরা এ বিষয়ে কিছু জানতেই পারেননি।
তাদের অভিযোগ, একটি দালাল চক্র সমিতির সভাপতি নূর ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাকিমের সঙ্গে আঁতাত করে কাঁচামাল আমদানির পর অবৈধভাবে বিক্রি করে দিয়েছে।
সমিতির সদস্য আনছার আলী জানান, তাদের সমিতির ১৩০ জন তাঁতির ১ হাজার ২৯০টি তাঁতের বিপরীতে প্রায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়েছে। অথচ তারা এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি।
তার অভিযোগ, সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক সাঁথিয়ার ব্যবসায়ী নয়নের মাধ্যমে কাঁচামালগুলো বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
কিছুদিন আগে বিষয়টি জানতে পেরে তারা সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের কাছে গেলে ভাড়াটে লোক দিয়ে প্রান্তিক তাঁতিদের মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ করেন। তিনি জানান, করোনার সময়ে প্রণোদনার টাকাও আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে তারা তাঁত বোর্ডে লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাকিম বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। তবে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল কী করেছেন, সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
একইভাবে আতাইকুলা ৬ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। এ সমিতির ১৭২ জন সদস্য লভ্যাংশের নামে পেয়েছেন ৭০০ টাকা করে।
পাবনা তাঁত বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিলেও তাঁতিদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রান্তিক তাঁতিরা সুবিধা পাচ্ছেন না।’
তাঁতিদের দেয়া অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার কামনাশিষ দাস।
তিনি বলেন, ‘তাঁতিদের জন্য সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধা এভাবে হরিলুট হওয়ায় বোর্ড এরই মধ্যে এ প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। সরাসরি তাঁতিদের কাছে সরকারি সহায়তা দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে।