শাটডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বসেছে নওগাঁ হাট গরুর বাজার। হাটে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, হুমড়ি খেয়ে নেমেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে দেদার বেচাকেনা। হাট কমিটির সভাপতি স্থানীয় এমপির ভাই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘করোনায় হাট বন্ধ রাখতে হবে কে বলেছে? তাড়াশ চলে আমাদের হুকুমে।’
বৃহস্পতিবার শাটডাউনের প্রথম দিনে নওগাঁ হাটে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়। হাট প্রাঙ্গণের বাইরে নওগাঁ জিন্দানী কলেজমাঠেও বসেছে গরু-ছাগল, কাঠের আসবাবপত্র ও মাছ ধরার চাঁইয়ের হাট। তবে হাটের কোথাও টোল চার্ট টাঙানো হয়নি।
সিরাজগঞ্জের পশুর হাটগুলোর মাঝে তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ হাট অত্যতম। এবার ভ্যাটসহ ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় আকবর আলী নামের এক ব্যক্তি এ হাট এক বছরের জন্য টোল আদায়ের ইজারা নেন।
তার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তিনি ইজারা নিয়েই শুরু করেছেন অতিরিক্ত টোল আদায়। এমনকি হাট প্রাঙ্গণের বাইরে নিজস্ব ঘরে যারা ব্যবসা করেন তাদের কাছেও তিনি টোল দাবি করছেন। ব্যবসায়ীরা এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করেছেন।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, পাবনার ভাংগুড়া, চাটমোহর ও নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী করতোয়া নদীর তীরে নওগাঁ হাট অবস্থিত। সড়ক ও নৌপথে যোগাযোগব্যবস্থার কারণে পাঁচ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ প্রতি বৃহস্পতিবার নওগাঁ হাটে কেনাবেচার জন্য আসেন।
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ তো কোথাও হাট বসার কথা না। কেন হাট বসল তা খতিয়ে দেখছি। আর ১২৫ ধরনের দ্রব্য কেনাবেচার জন্য টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। তা পুরোনো হওয়ায় নতুন করে মূল্য তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
‘বর্তমান মূল্য তালিকায় প্রতিটি গরু ও মহিষ সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা, প্রতিটি ছাগল ও ভেড়া ৫০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ক্রেতা শুধু টোল দেবেন। এ বিষয়ে ইউএনওকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি সার্বক্ষণিক তদারকি ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেবেন।’
শাটডাউনের মধ্যে তাড়াশের নওগাঁ হাট গরুর বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা
জেলা প্রশাসকের কথার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে হাটে । ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, একটি গরু কিনতে ক্রেতার কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা আর বিক্রেতার কাছ থেকে আদায় হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে ক্রেতার কাছ থেকে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, বিক্রেতার কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। ক্রেতাকে যে রসিদ দেয়া হচ্ছে তাতে টাকার অঙ্ক না লিখে, লেখা হচ্ছে পরিশোধ।
এ ছাড়া অন্য পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। এক হালি ডিম কিনলেও দিতে হয় দুই টাকা খাজনা। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছেই টোল আদায় করা হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন খন্দকার বলেন, ‘করোনা রোধে এখানে প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই। আর নওগাঁ হাটের অতিরিক্ত খাজনা ক্রেতাদের কাছে বাড়তি আতঙ্ক।
তাড়াশ বাজারে আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘আমি তিনটা হাঁস বিক্রি করেছি, খাজনা নিয়েছে ৩০ টাকা।
আরেক ক্রেতা লাবু সরকার বলেন, ‘৩০ টাকা দিয়ে একটি তরলা বাঁশ কিনেছি, খাজনা নিয়েছে ১০ টাকা।’
হাটে আসা ভাংগুড়া গ্রামের বাসেদ আলী বলেন, ‘আমাদের এলাকাতে সপ্তাহে এই এক দিন হাট বসে। সারা সপ্তাহের সদাই এই হাট থেকে কিনতে হয়। সরকার লকডাউন দিছে আর কী করা, আজ হাট থেকে সব কিনে নিলাম, কাল থেকে আর আসব না।’
হাটের বাইরের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামসহ অনেকের অভিযোগ, চলতি বছর হাটের ইজারাদার তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বার্ষিক টোল দাবি করেন, তাদের বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। অথচ হাটের বাইরে টোল আদায় করার কেনো এখতিয়ার নেই তার।
নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কাশেম বলেন, ‘কলেজ মাঠে হাট লাগানোর জন্য কেউ অনুমতি নেয়নি। আগেও টুকটাক হাট বসেছে। তাছাড়া স্থানীয় প্রভাবে অনেক কিছুই বলা যায় না।’
ইজারাদার আকবর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বহু বছর ধরেই হাটের ইজারাদাররা ওই সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক টোল ধার্য করে তা আদায় করে আসছেন। সে অনুযায়ী টোল চাওয়া হয়েছে।’
অতিরিক্ত টোল আদায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে ম্যানেজ করেই টোল আদায় করছি। তাদের শেয়ারও দিয়েছি। এ কারণে কেউ কিছু করতে পারবে না।’
ক্ষমতাসীন দলের কে কে রয়েছেন জানতে চাইলে আকবর আলী বলেন, ‘এমপির ভাই উকিল (নূরুল ইসলাম) এ হাটের সভাপতি।’
স্থানীয় এমপি ডা. আব্দুল আজিজের ভাই অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিয়মমতোই হাট চালাচ্ছি। ক্রেতা-বিক্রেতার কাছ থেকে খাজনা নেয়া আমাদের সিস্টেম। করোনায় হাট বন্ধ রাখতে হবে কে বলেছে ? সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়ে হাট নিয়েছি কি বন্ধ রাখার জন্য। আমি হাট বন্ধ রাখলে কি সরকার আমার কাছ থেকে টাকা কম নেবে। এসব লিখে কিছুই করতে পারবেন না। তাড়াশ চলে আমাদের হুকুমে।’
এ প্রসঙ্গে তাড়াশের ইউএনও মেজবাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে হাট বসানোর কোনো অনুমতি নেই। কেন হাট বসানো হলো তা এখনই খবর নিচ্ছি। একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। করোনার জন্য কলেজ বন্ধ থাকায় সাময়িকভাবে সেখানে হাট লাগানো হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে।