রোহিঙ্গা যুবককে ভালোবেসে ছেড়েছিলেন স্বজন, পরিবার। বাঙালি পরিচয় বদলে বেছে নেন রোহিঙ্গা জীবন। তবে যার জন্য ঘর ছাড়া সেই যুবকই এক সময় ছেড়ে যায় তরুণীকে। তত দিনে জন্ম নিয়েছে দুই সন্তান। দুই চোখে অন্ধকার দেখা তরুণী টিকে থাকার জন্য পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন মধ্যপ্রাচ্যে। তবে পাসপোর্ট করতে গিয়ে ‘মিথ্যা পরিচয়ের’ অভিযোগ ধরা পড়ে যেতে হয় কারাগারে।
সিনেমার কাহিনিকে হার মানানো এই তরুণীর নাম সিরাজ খাতুন। ২৫ দিন জেল খাটার পর মঙ্গলবার তিনি মুক্তি পেয়েছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে।
মানবাধিকার সংস্থার হস্তক্ষেপে জামিনে মুক্ত হয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের তিনি শোনান বিভীষিকাময় জীবনের গল্প।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের জিম্মায় গত ১৬ জুন সিরাজ খাতুনকে জামিন দেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন। এর পর মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
প্রেম যেভাবে পরিণত প্রতারণায়
রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া এলাকায় প্রায় এক যুগ আগে পরিচয় গোপন করে মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন রোহিঙ্গা যুবক মো. সিদ্দিক। পাশাপাশি অন্যের ফসলি জমিতে চাষাবাদও করতেন। সিদ্দিকের সঙ্গে ওই এলাকার সিরাজ খাতুনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০১০ সালে তারা পালিয়ে বিয়ে করেন। এরপর সিরাজ জানতে পারেন, তার স্বামী রোহিঙ্গা। শুরু হয় পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জীবন।
সিরাজ জানান, চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ঘুরেও কোথাও থিতু হতে পারছিলেন না তারা। ২০১৭ সালে পটিয়ায় থাকার সময় ধরা পড়েন পুলিশের কাছে। পুলিশ তাদের পাঠিয়ে দেয় উখিয়ার পালংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে বিভিন্ন দাতা সংস্থার ত্রাণের আশায় সিরাজকে রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন সিদ্দিক। সিরাজের নতুন নাম তখন সালমা খাতুন।
ক্যাম্পে নতুন চেহারা পায় সিদ্দিকের, নিয়মিত সিরাজকে নির্যাতন করতেন তিনি। এরই মধ্যে জন্ম নেয় দুই সন্তান। ২০১৯ সালে সিদ্দীক স্ত্রী-সন্তানদের রেখে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। অসহায় সিরাজ দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে যান রাঙ্গুনিয়ায় বাবার বাড়িতে।
মিথ্যা পরিচয়ের অভিযোগে কারাবাস
সিরাজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিবার জানত না আমি রোহিঙ্গাকে বিয়ে করেছি। সব শুনে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। মানসম্মান রক্ষায় আমাকে ওমান পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়।’
ওমান যাওয়ার জন্য ৩ জুন পাসপোর্ট বানাতে ডবলমুরিংয়ের মনসুরাবাদ কার্যালয়ে যান সিরাজ। তবে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা তাকে আটক করেন। সিরাজের ফিঙ্গার প্রিন্টে দেখা যায়, তিনি একজন রোহিঙ্গা, নাম সালমা খাতুন।
এরপর এক বছর বয়সী সন্তানসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সিরাজকে সহায়তায় এগিয়ে আসে চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফ। আইনি সহায়তা দিয়ে আদালতে বিষয়টি তুলে ধরে জামিন আবেদন করা হয়। বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে সিরাজকে জামিন দেন।
বিএইচআরএফ চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম জিয়া হাবীব আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই দফা আবেদন করেও সিরাজ খাতুনের জামিন হয়নি। তবে তৃতীয়বার আদালতের কাছে সিরাজ খাতুনের অসহায়ত্ব সম্পূর্ণ তুলে ধরলে বিচারক তা বুঝতে পারেন। অবশেষে তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন।’
মুক্তির পর সিরাজ বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় বার বার বলছিলাম, আমি রোহিঙ্গা না, প্রতারণার শিকার হয়েছি। কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। পরে আমার পরিবার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে বিষয়টি তুলে ধরে।
‘আমি ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ভোটার হয়েছি। আমি বাংলাদেশি। আমি তার (স্বামী) বিচার চাই। রোহিঙ্গা তালিকা থেকে মুক্তি চাই।’