শিক্ষিকাকে মারধরের মামলায় দপ্তরি হয়েছেন চাকরিচ্যুত, খেটেছেন জেল। এরপরই এলাকার লোকজন দপ্তরির পক্ষ নিয়ে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। গ্রামের হাজারও লোক মানববন্ধন করে জানিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদ।
এরপর সেই দপ্তরি জামিন পেয়েছেন। কিন্তু পরিষ্কার হয়নি ঘটনার নেপথ্যের কারণ। এ নিয়ে চলছে পুলিশের তদন্ত। তবে ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে ওই শিক্ষিকার সঙ্গে দপ্তরির পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুর কাশেম নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে যা ঘটেছে, তা পারিবারিক বিরোধের জের।
নিউজবাংলার সঙ্গে রোববার বিকেলে কথা হয় শিক্ষিকা নিলুফা খানমের। তিনি বলেন, ‘মামলার সাক্ষী ছোটন খান ও মঞ্জুর মণ্ডল দুজনই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। আদালতে তারা সাক্ষ্য দেবে না বলে জানিয়েছে। ভয়ে স্থানীয় লোকজনও দপ্তরির পক্ষে।’
তিনি দাবি করেন, ‘আমাদের সঙ্গে দপ্তরির পরিবারের জমিসংক্রান্ত বিরোধ কখনোই ছিল না। এর আগে তাদের সঙ্গে ঝগড়াও হয়নি। আমাদের একটি গাছের ডাল ভেঙে তাদের একটি ঘরের চালায় পড়া নিয়ে একটু মনোমালিন্য ছিল। সেটির সুষ্ঠু সমাধানও হয়েছিল। ওই দিন আমাকে মারধরের ঘটনাটি স্কুলসংক্রান্ত। দপ্তরির চাকরি চলে যাওয়ায় স্থানীয়রা আবেগ দেখিয়ে আমার বিপক্ষে চলে গেছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষিকা নিলুফা খানম ও দপ্তরি রাকিবের বাবারা পাঁচ ভাই। তাদের দাদা মারা যাওয়ার পর জমি বণ্টন নিয়ে নিলুফার পরিবারের সঙ্গে রাকিবের পরিবারের বিরোধ শুরু। রাকিবরা বরাবরই বলে আসছেন, তাদের ঠকানো হয়েছে।
ঈদের কিছুদিন আগে নিলুফাদের গাছের একটি ডাল ভেঙে পড়ে দপ্তরি রাকিবদের একটি খামারের ঘরে। এতে করে ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ নিয়ে বিরোধ আরও চরমে পৌঁছে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ঝগড়া আর মনোমালিন্য।
সবশেষ ৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাকিবদের পরিবারকে শান্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন ওই শিক্ষিকা। তবে রাকিবরা জানিয়েছেন, তারা ক্ষতিপূরণ পাননি। ওই শিক্ষিকার বাবার দোকান থেকে বাকিতে চার হাজার টাকার পণ্য নিয়েছিলেন। সেই টাকা আর ফেরত দেয়া হয়নি।
রাকিবের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওই দিনের ঘটনাটি স্কুলসংক্রান্ত না। পারিবারিক বিরোধের জেরে দপ্তরিকে চাকরিচ্যুত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সেদিন তাদের বাড়িতে জমিসংক্রান্ত বিরোধে দুই পরিবারের কথা-কাটাকাটি হয়েছে। পারিবারিক বিরোধটি স্কুলের ঘটনা বলে শিক্ষিকা অপপ্রচার চালিয়েছেন। ফলে দপ্তরির চাকরি চলে গেছে।
মানবাধিকার জোট ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, সেদিনের ঘটনায় শিক্ষিকা আইনের আশ্রয় নিয়েছেন, এটা ঠিক আছে। তবে যদি পারিবারিক বিরোধে ঘটনাটি হয়ে থাকে, তাহলে পারিবারিকভাবেই মীমাংসা হওয়া উচিত ছিল। কারণ পারিবারিক বিরোধ স্কুলে আনা ঠিক না। পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়ার মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই বহু মানুষ কষ্টে আছে। এর মধ্যে চাকরি চলে গেলে একটি পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন।
এই আইনজীবী বলেন, শিক্ষিকার করা ফৌজদারি মামলাটি তদন্ত করে যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে যে শাস্তি বিবাদীর হওয়ার কথা ছিল, ২১১ ধারায় বাদীকে সেই শাস্তি পেতে হবে। এ জন্য বিবাদীকে মামলা করতে হবে অথবা আদালত তাদের মামলা করতে নির্দেশ দিতে পারে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুর কাশেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত করে দেখেছি অনেক আগে থেকেই তাদের পারিবারিক বিরোধ রয়েছে। জমিসংক্রান্ত জের ছাড়াও ওই দপ্তরির পরিবারের একটি ঘরের চালে নিলুফাদের গাছের ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়া নিয়েও তাদের বিরোধ ছিল।
ওই দিন মারামারির ঘটনাটি পূর্ববিরোধের একটি অংশ। সম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদনটি চলতি মাসের শেষের দিকে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে জমা দেয়া হবে।
ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শফিকুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, শিক্ষিকার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে মামলাসহ রাকিবকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে এটি যদি স্কুলসংক্রান্ত ঘটনা না হয় কিংবা পারিবারিক বিরোধের ঘটনা হয়, তাহলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। পরে তদন্ত সাপেক্ষে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিলুফা খানম মামলার নথিতে উল্লেখ করেছেন, গত বৃহস্পতিবার (২৭ মে) সকাল ১১টার সময় দপ্তরি রাকিবকে স্কুল পরিষ্কার করার জন্য ফোন করি। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি। এমতাবস্থায় লোক পাঠিয়ে ডেকে এনে স্কুল পরিষ্কার করতে বলা হয়। এতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের গালাগাল ও হুমকি দিতে থাকে। তখন তাকে কিছু না বলে আমি বাড়িতে চলে যাই।
কিন্তু দুপুর দুইটার সময় আমার বাবা হাফিজ উদ্দিন খান মসজিদ থেকে বাড়িতে আসতে থাকে। রাস্তায় পথ আটকিয়ে রাকিবের বড় ভাই নাদিমের নির্দেশে দপ্তরি রাকিব আমার বাবাকে গালাগাল করতে থাকে। আমি এসে তাকে গালাগাল করতে নিষেধ করায় আমাকে রাস্তায় টানাহেঁচড়া করে মাটিতে ফেলে শ্লীলতাহানি ঘটায়। এ সময় দুই ভাই মিলে আমাকে বেধড়ক মারপিট করে। রাকিব আমার গলা চেপে ধরে হত্যার চেষ্টা করে। আমার চিৎকারে স্থানীয় রফিকুল ইসলামের ছেলে ছেটন খান ও বোচু মণ্ডলের ছেলে মঞ্জুর মণ্ডল উদ্ধার করে।
পরদিন শুক্রবার (২৮ মে) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পাগলা থানার বারইহাটি বটতলা এলাকা থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। এর পরেই রাকিবকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই দিন বিকেলে শিক্ষক নিলুফা খানম মামলা করার পর থেকে কারাগারে ছিলেন রাকিব।
তবে ১৮ দিন জেল খেটে গত ১৫ জুলাই আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে জানিনে মুক্তি পেয়েছেন। বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও দপ্তরির আইনজীবী নূরুল হক।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার ১৫৬ নম্বর বারইহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিলুফা খানম। একই স্কুলের দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী রাকিব খান। তারা বারইহাটি গ্রামের বাসিন্দা এবং দুই পরিবারের বাসা ও বিদ্যালয় পাশাপাশি। তারা সম্পর্কে আপন চাচাতো ভাইবোন।