১৯ জুন মধ্যরাতে সিলেটের ওসমানীনগরে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় তপতী রানী দে নামের এক বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষকের মরদেহ। পাশেই ঝুলছিল গৃহকর্মী গৌরাঙ্গ দাসের মরদেহ।
পুলিশের ধারণা, গৌরাঙ্গই তপতীকে গলা কেটে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। তপতীর ছেলে তন্ময় দে বিপ্লব তাকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন।
তবে গৌরাঙ্গের পরিবারের দাবি, তিনি হত্যা করেননি। তাকেও খুন করা হয়েছে।
এর আগে ১৬ জুন সিলেটের গোয়াইনঘাটে দুই শিশুসন্তানসহ আলেমা বেগম নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পরদিন আলেমার বাবা আয়ুব আলী অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা করেন।
তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, আলেমার স্বামী হিফজুর রহমানই এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার হত্যার দায় স্বীকার করে হিফজুর আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। তার দাবি ‘মাছ কাটার স্বপ্ন দেখে’ স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করেছেন তিনি।
এর আগের আলোচিত হত্যার ঘটনা ঘটে গত ২৮ মে দুপুরে। বালাগঞ্জের গহরপুর এলাকার রতনপুরে খুন হন ইটভাটার ব্যবস্থাপক ধীরাজ পাল।
নিজ কর্মস্থলে ধীরাজকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এই হত্যা মামলায় ছয় আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার পরও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
সিলেটের ওসমানীনগরে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক ও গৃহকর্মীর মরদেহ।
কেবল এই তিনটিই নয়, সম্প্রতি সিলেটে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। হঠাৎ করেই যেন সিলেটে বেড়ে গেছে খুনোখুনি।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩১৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৮ জুন থেকে ২০২০ সালের ১৭ জুন সিলেটে ৫৩টি হত্যা মামলা এবং ২০২০ সালের ১৮ জুন থেকে ২০২১ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত ৬১টি হত্যা মামলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে গৃহবন্দি থেকে দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাওয়ায় পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণেও বেড়েছে খুনোখুনি।
গত ৩০ এপ্রিল স্বজনরা পান সিলেটের আইনজীবী আনোয়ার হোসেন হত্যার খবর। কিন্তু প্রায় এক মাস পর জানা যায় তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তার করা হয় আনোয়ারের স্ত্রী শিপা বেগমকে। ১৩ জুন সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুর রহমানের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন শিপা।
আনোয়ার হত্যার দায় স্বীকার করে শিপা জানান, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তিনি স্বামীকে হত্যা করেছেন।
এদিকে ৭ জুন সিলেট নগরের কাজীটুলা এলাকার একটি ভবনের নিচ থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাবিদ আহমদ নাজিম নামের এক যুবককে। ওই দিন দুপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নাজিমের পরিবারের করা হত্যা মামলায় তার সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকা খালাতো ভাইবোন পরিচয় দেয়া তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে শাহনিয়া বেগম ও তার ভাই আকবরকে গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
বালাগঞ্জের গহরপুর এলাকার রতনপুরে খুন হন ইটভাটার ব্যবস্থাপক ধীরাজ পাল।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) লুৎফর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, সিলেটে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে বিভিন্ন কারণে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক কলহ ও জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হত্যাগুলো হচ্ছে। মানুষজন এখন তুচ্ছ কারণেও খুন করে ফেলছে।
এ বিষয়ে সিলেট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক সেলিম বলেন, ‘শুধু সিলেট নয়, সারা দেশে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। তবে সিলেটে ইদানীং অবস্থা খুব খারাপ। গত দুই মাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
‘এই হত্যা থেকে বাদ পড়েননি আমাদের পেশার মানুষও। আমার মনে হয় এই করোনাকালে দীর্ঘ সময় মানুষজন ঘরে থেকে, আর্থিক অভাব অনটনে মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়ছেন। তুচ্ছ ঘটনায় যে কেউ অন্যের ওপর চড়াও হন, যার পরিণতি হয় হত্যা।’
এই আইনজীবী জানান, করোনাকালে আদালতে গিয়ে মামলা করা যায় না। আদালতের অনেক সীমাবদ্ধতা বেড়ে গেছে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে ঘরে বসে জামিন নেয়া যায়। এসব সুযোগ থাকার কারণেও মনে হয় মানুষজন হত্যায় প্ররোচিত হচ্ছেন।
সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, ‘আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় এটা বলতে পারি, সিলেটে অনেক তুচ্ছ কারণে হত্যাকাণ্ড হয়। আর আসলে আমাদের মধ্যে এখন আর আগের মতো পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন নেই। আপনজনের প্রতি আস্থা, মূল্যবোধ নেই। কেউ কাউকে সাহায্য করতে চান না।
‘তাই স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করছে। স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করছে। ছেলে মাকে হত্যা করছে আর মা ছেলেকে হত্যা করছে।’
তার মতে, শুধু আইনি শাস্তি দিয়ে এই অপরাধমূলক কাজ থেকে মানুষকে ফেরানো যাবে না। মানুষের এই নৃশংস মনোভাব থেকে উত্তরণের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব জায়গা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।